মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বেঁচে থাকার জন্য কত দরকার

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

বেঁচে থাকার জন্য কত দরকার

‘পেটে খেলে পিঠে সয়’- এ রকম একটা প্রবাদ বহুদিন ধরে প্রচলিত আছে। প্রবাদটির অনুকরণে আমি বলতে চাই ‘পেটে খেলে পিঠে সয়; বেশি খেলে অঙ্গে ক্ষয়।’ বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি জীবকেই কিছু না কিছু খেতে হয় পুষ্টির জন্য। দেহের বিভিন্ন অঙ্গের বেঁচে থাকার উপকরণ বা পুষ্টি সরবরাহের জন্য। সুতরাং মানুষ খাবে, বাঁচবে, তার দৈহিক সক্ষমতা বাড়বে। মানুষ বিদ্যা এবং বুদ্ধির উৎকর্ষতা, বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে বিশ্বকে জয় করবে সেটাই স্বাভাবিক। সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতিচর্চায় নিজেদের বিকশিত করবে। সমাজকে আলোকিত করার মাধ্যমে দেশের মানচিত্র, পরিচিতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠস্থানে পৌঁছে দেবে। আমার প্রশ্ন, কাগজের টাকা, সরকারি কোষাগারের কাগজ কি খেয়ে পুষ্টি সরবরাহ করা যায়? সরকারি কোষাগারের টাকা সরকার খায় না। সরকার কোষাগারের টাকা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে।

সরকারি অর্থ নিজের জন্য নয়। আমরা যখন ভাবী, উত্তরাধিকারীদের জন্য কী করেছি, কী করব তখন একবারও এ কথা ভাবী না- আমার বাবা তো এই শিক্ষা আমাকে দেননি। স্রষ্টায় বিশ্বাসীরা জীবনকে স্রষ্টা ও ভাগ্যের ওপর ন্যস্ত করেন। উপমহাদেশে বহু ধর্মের মানুষের সম্মিলন ঘটেছে। ধর্মে বিশ্বাসীর অভাব নেই, কিন্তু প্রতিপালনে বৈসাদৃশ্য রয়েছে। বাহ্যিকভাবে যতটুকু পালন করি, আন্তরিকভাবে তা ধারণ করি না। সমাজে অস্থিরতার একটা প্রধান কারণ হলো দ্রুত সম্পদশালী হওয়ার প্রবণতা। একবার সম্পদশালী হলে সম্পদের জ্যামিতিক বৃদ্ধি ঘটানোর তৎপরতা থাকে। হিন্দুশাস্ত্রে একটা প্রবচন আছে- ‘সম্পদ তিন প্রজন্মের বেশি এক ঘরে থাকে না।’ ঐতিহাসিক স্বীকৃত এই প্রবচনটির সত্যতা মেলে যখন আমাদের এই উপমহাদেশের জমিদার বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দিকে তাকাই। জমিদারদের সেই কৌলীন্য আজ আর নেই। তা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে।

আমরা সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে যদি ১৬-১৭ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কিঞ্চিৎ চেষ্টা করতাম, তা বোধহয় সম্ভব হতো। এটা সম্ভব কেবল গ্রামীণ অর্থনীতির পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের দ্বারা। অন্যদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সুশিক্ষাদানের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব। অর্থাৎ গ্রামে আমার সব সম্পদ উজাড় করে দেওয়ার মাধ্যমে তা সম্ভব। গ্রাম ও শহরের পার্থক্যটা একটা সূক্ষ্ম সরল রেখার কাছে নিয়ে আসা। আত্মসম্মান অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষা হলো সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মানবজীবনে আত্মমর্যাদার জন্য শিক্ষা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বিস্তারের মাধ্যমে জাতীয় জাগরণ সম্ভব। এখন কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। সাধারণ কৃষকের জীবনমানে পরিবর্তন এসেছে। তারা অধিক উৎপাদনের জন্য নিজেদের আরও উজাড় করে দিচ্ছে। কৃষকই আমাদের দেশের উন্নয়নে প্রকৃত ভূমিকা পালন করছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে যেসব কৃষিপণ্য মানবজাতির জন্য ক্ষতিকারক (যেমন তামাক), তা উৎপাদনে বিরত থাকার। প্রয়োজনে সেসব কৃষককে প্রণোদনা দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ও লাভজনক পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিনা সুদে, বিনা শর্তে ঋণ দিয়ে সাহায্য করতে হবে; যেমনটি পিকেএসএফ শুরু করেছে। কৃষিক্ষেত্রে জাতির মেরুদ- কৃষককে পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করা। যেহেতু একবার গাছ রোপণ করলে ৪০-৫০ বছর অবধি বেঁচে থাকে। গাছ নিয়মিত ফল দেয়। সেসব ফলের বীজ থেকে তেল বা অন্যান্য প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য উৎপাদিত হয়। একবার যদি বাঙালি কৃষককে উপায় বলে দেওয়া যায় তাহলে সে উৎপাদন করেই ছাড়বে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষার ভীতিপ্রদ পরিবেশ ছাড়া নানা রকমের ছাত্র মূল্যায়নসংক্রান্ত ভাবনা উদ্ভাবন করতে হবে। গ্রেড প্রথার প্রচলন ঘটায় ছাত্রদের মনে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে। তাদের মৌলিক জ্ঞানের পরিবর্তে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব গড়ে উঠেছে। সুতরাং গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য, বাংলাদেশের সব গ্রামের জন্য একই পরিকল্পনা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার সঙ্গে খুলনা-সাতক্ষীরার জলাবদ্ধ এলাকার, কুমিল্লার গ্রামের সঙ্গে চট্টগ্রামের পাহাড়ি গ্রামীণ এলাকা বা জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন একই সুতায় বাঁধা যাবে না। তাই স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক জনসম্পৃক্ততা রেখে, স্থানীয় জনগণের মধ্যে থেকে সৎ, জ্ঞানী, চরিত্রবান লোকদের বেছে নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ, পরিকল্পনা গ্রহণ, অর্থ ব্যয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে।

গ্রামীণ প্রকল্প বাস্তবায়নে যতগুলো বাধা আসতে পারে সেগুলো দ্রুত অপসারণে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে নজর দিতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য, স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি অনেক কাজের গতি শ্লথ করে দেয়। অবশ্যই কাজের গুণগতমানও বাধাগ্রস্ত করে। বার বার মনে হয়, মহাত্মা গান্ধীর ‘Wealth without work’ অর্থাৎ বিনা কর্মে বা পরিশ্রমে বিত্তবান হওয়া। তাতে আপত্তি নেই, আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, আমরা চাই বিনাশ্রমে দ্রুত ধনী হতে। যার প্রচলিত ধারায় একটি হলো ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ফেরত না দেওয়া, দ্বিতীয়টি হলো চাঁদাবাজি এবং তৃতীয়টি হলো নির্দিষ্ট কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের এক-তৃতীয়াংশও খরচ না করে বাকি টাকা পকেটস্থ করা।

উন্নয়ন ও অসাম্প্রদায়িক গ্রামীণ স্বার্থ সুরক্ষা করতে হলে বাংলাদেশে এক শিক্ষিত রাজনৈতিক শ্রেণির প্রয়োজন। যে নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্ব দেবে- ভোগ ও লালসা ত্যাগ, উদারতা ও সহানুভূতিকে। যার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, উন্নয়নের চিন্তা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, বিনয় ও সহানুভূতি। আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রবল। অকপটতা একদিন দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে। মহামতি লেনিনের ভাষায়, নাগরিক ও সামাজিক সচ্ছলতা শুধু সম্পদের সুষম বণ্টন নয়, সব নাগরিক সব ক্ষেত্রে সমঅধিকার ভোগ করবে। মানুষের স্বাভাবিক যোগাযোগের সঙ্গে প্রযুক্তিগত যোগাযোগ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতায়নও জরুরি। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আমাদের কয়লা, প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। জোর দিতে হবে দূষণমুক্ত শক্তি উৎপাদনের ওপর যা সৌর, বায়ু, পারমাণবিক ও জল থেকে উৎপাদিত হতে পারে। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরশক্তি উৎপাদনের নয়া মাত্রা ঘোষণা করেছে।

গ্রামকে বিকশিত, একই সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নয়নের অংশীদার করতে হলে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালামের মতামত বিবেচনা করা যেতে পারে- ক. কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খ. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যপরিষেবা গ. পরিকাঠামো- বিশ্বাসযোগ্য এবং গুণগত বিদ্যুৎ শক্তি, ভালো সড়কব্যবস্থা ঘ. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ঙ. জটিল প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি নিয়েই বলেছেন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। তরুণ বিজ্ঞানীরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেবে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এজন্য সম্পদের সুষম বণ্টন ও কৃষি -জমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর