ওপরে হইচইয়ের শেষ নেই, বরঞ্চ বাড়ছেই। সহিংসতা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজনীতিতে পরস্পরকে আক্রমণের ব্যাপারে কোনো প্রকার আলস্য দেখাচ্ছে না। সামাজিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হচ্ছে জনপদ। আবার উন্নতি যে হয়নি, তা-ও নয়। গাড়ির সংখ্যা ও মান বেড়েছে। দালানগুলো উঁচু হয়েছে, বিলাসের প্লাবণ। দেশের দারিদ্র্যকে নির্মমভাবে উপহাস করছে।
ওপরে তো এসব দেখছি, কিন্তু ভিতরের সত্যটা কী? সেটাও আমাদের জানা। মানুষ লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছে। প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে, আমাদের এই রাষ্ট্র কি ব্যর্থ, এ কি অকার্যকর? প্রশ্নের জবাবটা নির্ভর করছে-কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি দেখছেন তার ওপর। শাসকশ্রেণির নাকি জনগণের? আমাদের এই রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির দৃষ্টিতে দেখলে রাষ্ট্র ব্যর্থ নয়, অকার্যকরও নয়। তবে জনগণের দৃষ্টিতে দেখলে ব্যাপারটা অন্য রকম মনে হবে।
কিন্তু কোন রকম? ব্যর্থ, নাকি অকার্যকর? না, কোনোটাই নয়, বরঞ্চ বলতে হবে, এই রাষ্ট্রের ভূমিকা শত্রুতার। শত্রুতা করছে সে জনগণের স্বার্থের সঙ্গে। শত্রুতার ওই কাজে এই রাষ্ট্র সম্পূর্ণ সফল এবং অত্যন্ত দক্ষ। হ্যাঁ, এমনটা তার করার কথা ছিল না। জনগণই এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, শাসকশ্রেণির স্বার্থ দেখার জন্য নয়, জনগণের স্বার্থ দেখভাল করার জন্যই।
আসলে শাসকশ্রেণি বলতে আলাদা একটা শ্রেণি থাকবে, এ কথাটাই জনগণ ভাবেনি। তারা যুদ্ধ করেছে একাত্তরে, সংগ্রাম করেছে তারও অনেক আগে থেকে। রাষ্ট্রকে ছোটবড় কিংবা কেবল স্বাধীন করার জন্য নয়, রাষ্ট্রকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মুক্তি অর্জনের জন্যই। সে মুক্তি তো আসেইনি, উল্টো মানুষের ভাগ্যে জুটেছে লাঞ্ছনা ও অপমান।
যে প্রশ্নটির মীমাংসা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা আশা করেছিলাম, সেটা হলো নতুন রাষ্ট্রের মালিকানার প্রশ্ন। রাষ্ট্র যে জনগণের হবে, এ নিয়ে সেদিন সংশয় দেখা দেয়নি। সংবিধানে লেখা হয়েছিল সে মীমাংসার কথা। কিন্তু তারপর রাষ্ট্র ফিরে গেছে তার আগের অবস্থায়। ক্ষমতা চলে গেছে নতুনভাবে পুষ্ট একটি শাসকশ্রেণির হাতে, যারা বিভিন্ন নামে (এমনকি পোশাকেও) রাষ্ট্র শাসন করছে, শাসনের অধিকার নিয়ে হইচই বাধাচ্ছে নিজেদের মধ্যে, লিপ্ত রয়েছে গৃহবিবাদে এবং উৎপীড়িত ও অপমানিত করছে মানুষকে। রাষ্ট্র যে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি সেটা শাসনতন্ত্রের মূলনীতিতে যে মর্মান্তিক পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার দিকে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে যায়। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বিতাড়িত হয়েছে। গণতন্ত্রের কথা সংবিধানে এখনো আছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কোনো নিদর্শন দীর্ঘদিন ধরেই চোখে পড়ে না। সন্ত্রাসপীড়িত এবং উৎপীড়িত ও অপমানিত মানুষের জীবনে সত্য হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা, আস্থাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতা; যে তিনটি অনুভব পরস্পরসংলগ্ন বটে। নিরাপত্তাহীনতা কাকে বলে তার চরম দৃষ্টান্ত ছিল একাত্তরের যুদ্ধের সময়। ন্যায়বিচার বলতে দেশে তখন কিছুই ছিল না। কারণ দেশ ছিল হানাদারদের দখলে। কিন্তু আমাদের সামনে এখন তো আর একাত্তর নেই, এখন তো আমরা স্বাধীন। তবু মানুষ তো নিরাপদে নেই।
আমাদের এই রাষ্ট্র যে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়াতে আগ্রহী হবে না, তার লক্ষণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, যখন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো না এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী অনেককে ক্ষমা করে দেওয়া হলো। সাধারণ মানুষ মুখ ফুটে বলুক না বলুক তারা বুঝল, অত বড় অপরাধ যখন ক্ষমা পেয়ে গেল, তখন অন্য অপরাধীদের যে যথার্থ বিচার হবে, এমন আশা করা অসংগত। শাসকশ্রেণির চোখে রাজাকাররা তখন শত্রু ছিল না, কেননা রাজাকাররা তখন অপরাধী এবং শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতায় উন্মুখ। শত্রু হচ্ছে বামপন্থিরা। বিশেষ করে তথাকথিত উগ্র বামপন্থিরা, যারা তাদের অবস্থানগত কারণে শাসকশ্রেণির সঙ্গে বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল। তাই দেখা গেল রাজাকারদের যখন ক্ষমা করে দেওয়া হচ্ছে।
তখন সেই একই নিঃশ্বাসে বলা হচ্ছে নকশালপন্থিদের দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলো। রাজাকাররা সেই যে অব্যাহতি পেয়ে গেল তারপর তারা কীভাবে নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করেছে, সেটা তো আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। বিএনপি ওই অপরাধীদের আপন করে নেয়, আওয়ামী লীগও একসময় তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক, কেননা দীর্ঘদিন ধরে পালাক্রমে ওই দুই দলই আমাদের শাসকশ্রেণির প্রধান অংশ ছিল। এবং মুখে যা-ই বলুক আমাদের শাসকশ্রেণির কোনো অংশই প্রকৃত অর্থে মৌলবাদীবিরোধী নয়।
এই রাষ্ট্রে বৈষম্য আছে। বৈষম্য থাকলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। ওই বৈষম্য দূর করার জন্যই রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কথা এসেছিল। সেসব কথা এখন আর নেই, যাতে বোঝা যায়, বৈষম্যকে মেনে নেওয়া হয়েছিল। এ রাষ্ট্রে রয়েছে অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, তাদেরও সাংবিধানিকভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়নি এবং বাস্তব ক্ষেত্রে দুর্বল সংখ্যালঘু হিসেবে তারা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ইতিহাস নির্মাতারা যা ভুলে যান তা হলো, পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণ যখন শুরু হয় তখন মানুষ কোনো ঘোষণার জন্য কান খাড়া করে বসে থাকেনি। আক্রমণের মুখে যে যেভাবে পেরেছে রুখে দাঁড়িয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এবং খেয়াল করেন না এই সত্যও, স্বাধীনতার যে সংগ্রাম সেটা ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শুরু হয়নি, সে রাতের পর থেকে সেটা একটা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিল বটে, কিন্তু উনসত্তরেই মানুষ অভ্যুত্থান করেছে, সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফা নয়, এক দফার পক্ষেই ভোট দিয়েছে। এবং তারও আগে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক ও প্রতিরোধী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে স্বাধীনতার জন্য আকাক্সক্ষাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে সেই ১৯৫৬-তে মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, যখন ওই রকমের বক্তব্য অন্য কেউ উপস্থিত করার কথা ভাবেননি, বলতে সাহস করা তো দূরের কথা।
২০২৪-এর অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল আপামর জনগণ কিন্তু ‘কৃতিত্ব’ নিয়েছে কতিপয় মেটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নকারী নেতা। এতে তাদের মুনাফা আসছে। লড়াইটা আদর্শের নয়, লড়াইটা স্থূল বস্তুগত স্বার্থের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনো একই লড়াই আমরা দেখেছি। তখন তৎপর ছিল শাসকশ্রেণির একাংশ। তারা সবকিছুতেই শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারকে টেনে নিয়ে এসে নিজেদের বড় করার তালে ছিল। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগই নেতৃত্ব দিয়েছে, সেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য; কিন্তু তাই বলে জনগণের যে কোনো ভূমিকা ছিল না, তা তো নয়। উল্টোটাই বরঞ্চ সত্য। এ দেশে যত তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তার প্রত্যেকটির পেছনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। তারা ভোট দিয়েছে, আন্দোলন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধও করেছে। কিন্তু তাদের ভূমিকা প্রায় কেউই স্বীকার করেনি।
স্বাধীনতাযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ককারী শাসকশ্রেণির দলের মধ্যে আশ্চর্য মিল এখানে, সবাই মনে করে যা করার তারাই করেছে; জনগণ ছিল না, জনগণ অংশ নেয়নি, দুঃখ ভোগ করেনি, লড়াই করেনি সামনাসামনি, প্রাণ দেয়নি হাজারে হাজারে। অভিন্ন ঘটনা ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে। ইতিহাসের আসল বিকৃতি যে জনগণের এবং তাদের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির (তারা যতই বিক্ষিপ্ত হোক) অস্বীকৃতির, সেই জ্ঞান বিবদমান বুর্জোয়া দলের রাজনীতিকদের তো নেই-ই, অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরও নেই। আমাদের শাসকশ্রেণি জনগণ থেকে কতটা যে বিচ্ছিন্ন, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে তারই একটি পরিমাপ সম্ভবপর।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়