রবিবার, ৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের সুবিধা-অসুবিধা

নাফিসা বানু

চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের সুবিধা-অসুবিধা

সবার জীবনে ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা স্বপ্ন বা চিন্তাভাবনা থাকে। আমিও একটা ছোট্ট স্বপ্ন দেখেছিলাম যে পড়াশোনা করে একদিন ভালো একটি চাকরি করব। এ চিন্তাভাবনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমকমে (ফিন্যান্স) পড়তে পড়তে পত্রিকায় বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে থাকি, একসময় নজরে এলো একটা গ্রুপ অব কোম্পানিতে হেড অব অ্যাকাউন্টসের চাকরির বিজ্ঞাপন। ভাবলাম প্রাইভেট চাকরি দরখাস্ত করেই দেখি। আমি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি তা আব্বু চাইতেন না বা পছন্দ করতেন না। তার পরও সাহস করে দরখাস্ত করলাম। আমাকে ইন্টারভিউতে ডাকা হলো। আব্বু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে গেলাম, একটু অবাক হলাম এত বড় পোস্টে আমাকে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই নিয়ে নিল! এক সপ্তাহের মধ্যে অফিস শুরু করলাম। প্রথম দিন অফিসে গেলাম কিন্তু আমাকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হলো না। দ্বিতীয় দিনও গেল। তৃতীয় দিন আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম আমাকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন? তিনি বললেন, কয়েক দিন পর আপনার কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে, আপনি এর মধ্যে আমার সঙ্গে কাজ করুন। উল্লেখ্য, এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকই আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। তারপর দেখলাম তিনি আমাকে তার পারসোনাল কাজ দিয়েছেন। আমি একটু বিরক্তবোধ করি। এরই মধ্যে কোম্পানির একটা প্রজেক্টের কনসালট্যান্ট এলেন অফিসে। তিনি আমাকে দেখে বললেন, মা! তুমি তো মনে হয় ভদ্রঘরের মেয়ে, তুমি কি এখানে কাজ করতে পারবে? কথাটা শুনে আমার একটু খটকা লাগল। আমি পরদিন অফিসে এসে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বললাম, স্যার! আমাকে যে কাজের জন্য নেওয়া হয়েছে আমাকে সেই কাজটা করতে দিন। তিনি তখন বললেন, আপাতত আমি আপনাকে যে কাজ দেব সেটাই করবেন। শুনে আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি এমডি সাহেবের মুখের ওপরই বলেছিলাম আমি কোনোভাবেই আপনার এখানে কাজ করব না, যদি না আমাকে যেজন্য চাকরি দেওয়া হয়েছে সে কাজ দেওয়া হয়। আমি তাকে বললাম, অন্যথায় আমি আপনার এখানে কাজ করব না। তিনি তখন একটু রেগে বললেন, আপনি আমার মুখের ওপর কথা বলেন! আমি বললাম আপনিই আমাকে আপনার মুখের ওপর কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই বলে আমি রিজাইন দিয়ে চলে এলাম বাসায়। এর কিছুদিন পর যখন কোনো সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখছি না তখন আরেকটা প্রাইভেট কোম্পানির চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আব্বুকে বললাম দরখাস্ত করে দেখব কি না। আব্বু নিমরাজি। আব্বুকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম, কিন্তু পরীক্ষা তেমন ভালো হয়নি। আমি যখন পরীক্ষা দিচ্ছিলাম তখন লক্ষ্য করি একজন লোক আমাকে কাচঘেরা একটা ঘর থেকে বারবার দেখছিল। সম্ভবত তিনি কোম্পানির মালিক। বিকালে বাসায় একজন ভদ্রলোক এলেন। তিনি বললেন, আপনি যেখানে পরীক্ষা দিয়ে এসেছেন আমি সেখান থেকে এসেছি। আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে? বললাম ভালো হয়নি। তিনি বললেন, চাইলে আপনাকে এখানে চাকরি দিতে পারি। আব্বু সব শুনে বললেন, আমার মনে হয় না ওখানে চাকরি করা তোমার জন্য ভালো হবে, ওরা অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই আব্বুর কথায় আর এই চাকরি করতে রাজি হইনি।

এর কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখি এবং সেখানে দরখাস্ত করি। সেখানে তিনবার মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। আমার সঙ্গে এবার আমার দুই ভাই গিয়েছিল পরীক্ষার হল অবধি। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আপনি ভাইদের সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছেন এখানে চাকরি করবেন কেমন করে? তখন বলেছিলাম, আমি একাই আসা -যাওয়া করতে পারব। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে (প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা) মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে আমার চাকরি হলো। সেখানে কাজ করে যাচ্ছিলাম পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমকমের ক্লাস করছিলাম। এ অফিসের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা আমি যার অধীন ছিলাম, তিনি আমাকে কিছুটা সুযোগ করে দেওয়ায় আমি মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস এবং সময় সময় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাই। ভদ্রলোকের বাসা ছিল আমরা যে এলাকায় থাকতাম সে এলাকায়। আমি অফিসের বাসে আসা-যাওয়া করতাম। তিনি যখন অফিসে যেতেন তখন দেখতেন আমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তিনি একদিন গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার সঙ্গে যেতে বললেন। আমি কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাড়িতে উঠলাম। এভাবে দেখা গেল তিনি প্রতিদিনই আমাকে তার গাড়িতে উঠতে বলছেন, কিন্তু আমি রাজি হইনি। যা হোক, এতে তিনি তেমন মনঃক্ষুণ্ণ হননি। আমি তাকে বলেছিলাম, স্যার! আমি একজন জুনিয়র অফিসার হয়ে আপনার গাড়িতে আপনার সঙ্গে প্রতিদিন যাব এটা খুব দৃষ্টিকটু দেখায়। ভদ্রলোক ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমার অস্বস্তির কারণ উপলব্ধি করে বলেছিলেন, ঠিক আছে, আপনার যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই যান।

এখানে গল্পগুলো বলার একটা কারণ হলো আমাদের সমাজে বা দেশে অবিবাহিত মেয়েদের চাকরি করা বেশ কঠিন। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি তা বুঝতে পেরেছি। অবিবাহিত একজন মহিলা চাকরি করতে গেলে তাকে সমাজের অনেক কিছুই খেয়াল করে চলতে হয়। তবে সব সময় যে পরিবেশ খারাপ হবে তা নয়। ১৯৯২ সালের অক্টোবরে আমি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ছেড়ে চাকরি নিলাম বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)-তে। এখানে আমি ডেপুটি ম্যানেজার (অর্থ) সরকারি গ্রেড-৬-এ চাকরি পেলাম। এখানে আমি যার অধীনে সরাসরি কাজ করেছি সব চাইতে বেশি সময় তিনি ছিলেন আমাদের সিএ অ্যান্ড এফও (প্রধান হিসাব ও অর্থ কর্মকর্তা)। পরবর্তীতে তিনি সদস্য (অর্থ) হিসেবে আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন অতিশয় ভদ্র এবং ভালো মানুষ। তাঁর অধীনে কাজ করে আমি ভীষণ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। তাঁর অধীনে আমি দীর্ঘ ২৩ বছর চাকরি করেছি। তিনি আমাকে ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। বেপজায় যোগদানের পরপরই ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে আমার বিয়ে হয় এবং বর্তমানে আমি বেপজার সদস্য (অর্থ) হিসেবে কাজ করছি। সংসার করে মেয়েদের জীবনে চাকরি করা বেশ কঠিন। ঘর সামলে অফিস করা কষ্টসাধ্য। যা হোক, আজকাল বেশির ভাগ মেয়েই ঘর সামলেও চাকরি করছে দেখে খুব ভালো লাগে। আজকালকার মেয়েরা চাকরির ক্ষেত্রে অনেক বেশি মনোযোগী, কর্মঠ এবং আন্তরিক। এর কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয় মেয়েরা জানে প্রতিযোগিতামূলক সমাজে তাদের অফিসের কাজ অফিসে শেষ করে তবেই বাসায় যেতে হবে, কারণ বাসায় তার জন্য সাংসারিক অনেক কাজ অপেক্ষা করছে। এটা অনস্বীকার্য যে মেয়েরা অনেক প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করে থাকে। একটা মেয়ে কী ধরনের বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে তার কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরাই আমার এ লেখার উদ্দেশ্য। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য জীবনে অনেক বাধাবিপত্তি আসে তবে তা ওভারকাম করে একটা সময়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। আমার জীবনের উপলব্ধি থেকেই আমার এ কথাগুলো বলা। আল্লাহর রহমতে আমার সংসার বেশ সুখের। আমার একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টারি পাস করেছে। স্বামী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। শাশুড়ি ও ননদকে সঙ্গে নিয়ে আমার সংসার ভালোই চলেছে। আমার দীর্ঘ ৩০ বছরের চাকরি জীবনে আমার সঙ্গে অনেক পুরুষ এবং মেয়ে সহকর্মী কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন। মেয়েদের আমি সব সময় আন্তরিকভাবে কাজ করতে দেখেছি। এর মানে এই নয় পুরুষ সহকর্মীরা কাজ করেন না, তারাও কাজ করেন। তবে কেন জানি আমার মনে হয় মেয়েরা কাজকর্মে তেমন ফাঁকি দেয় না। অনেকেই ভাবতে পারেন আমার এ মনোভাবটি পক্ষপাতমূলক। হতেও পারে। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আমার চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি তা-ই তুলে ধরলাম। আমার চাকরি জীবনের আরেকটি অভিজ্ঞতা হলো, সরকারি অফিসে মেয়েদের চাকরি করার পরিবেশ অনেক ভালো, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি সব সময় মেয়েদের জন্য অনুকূল পরিবেশের হয় না। তবে ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই আছে। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে হলে লিঙ্গবৈষম্য দূর করা একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : সদস্য (অর্থ), নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর