সুখময় ও নিরাপদ জীবন লাভে কোরআন মাজিদে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অতি ফলপ্রসূ দুটি নির্দেশনা রয়েছে। একটি হচ্ছে ‘তাকওয়া’ আরেকটি ইস্তিগফার। তাকওয়া মানে কী? তাকওয়া শব্দের শাব্দিক অর্থ বেঁচে থাকা। হাফেজ ইমাদুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে উমর ইবনে কাসির রহ. (৭০০ হি.- ৭৭৪ হি.) তাকওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর ভয়ে শিরক থেকে বেঁচে থাকা এবং তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য করা। (তাফসিরুল কোরআনিল আজিম, ১/৫৪ দারুল হাদিস কায়রো মিসরের সংস্করণ)।
আল্লামা আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল কুরতুবী রহ. (মৃত্যু-৬৭১ হিজরি) তাঁর তাফসির গ্রন্থে তাকওয়ার ব্যাখ্যায় বলেন :
একবার আমিরুল মুমিনিন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)কে তাকওয়ার পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। উবাই (রা.) তখন পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন। আমিরুল মুমিনিন! আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় দিয়ে পথ চলেছেন? উমর (রা.) বলেন, হ্যাঁ। উবাই (রা.) বলেন, তখন কীভাবে পথ চলেছেন? কাপড় টেনে খুব সতর্কতার সঙ্গে চলেছি, যেন গায়ে কাঁটা না লাগে- উমর (রা.) এর জবাব। উবাই (রা.) বলেন, এটাই তাকওয়া। অর্থাৎ খুব সতর্কতার সঙ্গে দুনিয়ার জীবন এমনভাবে অতিবাহিত করা, যাতে কখনো আল্লাহর নাফরমানি না হয়ে যায়। আমার স্রষ্টা যেন সব সময় আমার ওপর সন্তুষ্ট থাকেন। (আল জামে লি আহকামিল কোরআন, ১/১৪৭)।
আমাদের জীবনতরি অনিশ্চয়তা আর সংকটের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে অহর্নিশ। সংকট যেন আমাদের পিছু ছাড়ে না। একটা সংকট কাটল তো আরেকটা এসে হাজির। যাপিত জীবনে এভাবেই আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ছুটে চলছি। তো সংকট জর্জরিত জীবন থেকে মুক্তি পেতে, আঁধার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যেতে মানবতার মুক্তির মূলমন্ত্র আল কোরআনুল কারিমের নির্দেশনা কী? চলুন দেখি কোরআন মাজিদের ভাষায় সংকট মুক্তির কালজয়ী নির্দেশনার গল্প শুনে আসি-
যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে তথা তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিজিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহই তার (কর্মসম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, আল্লাহ তাঁর কাজ পূরণ করেই থাকেন। (অবশ্য) আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। (সুরা তালাক ৬৫ : ২-৩)।
আয়াতের নির্দেশনা সুস্পষ্ট। তাকওয়াপূর্ণ জিন্দেগি অবলম্বন সব সংকট নিরসনের মূলমন্ত্র।
ইস্তিগফার মানে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। মহান প্রভুর দরবারে নিজের ক্ষুদ্রতা, অসহায়ত্ব আর সীমাহীন দুর্বলতা প্রকাশ করে তাঁর কাছেই ফিরে যাওয়া। বাস্তবিক পক্ষে প্রতিটি মানুষই দুর্বল। অসহায়ত্বের চাদরে মোড়ানো মানবজীবন। চিরসত্য এ কথাটিই ইরশাদ হয়েছে পবিত্র কোরআনুল কারিমে : আর মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সুরা নিসা ৪ : ২৮)।
তাই দেখা যায় দুর্বল মানুষ প্রায়শই প্রবৃত্তির তাড়নায় নানা গুনাহে জড়িয়ে নিজের জীবনকে অশান্তির দাবানলে ফেলে দেয়। নিজেকে ভয়াবহ শাস্তির উপযুক্ত করে নেয়। দয়াময় আল্লাহতায়ালা তাঁর দুর্বল অসহায় বান্দাদের ভয়াবহ শাস্তি থেকে বাঁচতে একটি অনন্য উপায় বাতলে দিয়েছেন। অশান্তির দাবানল থেকে বেঁচে সুখের নির্মল উদ্যানে বিচরণের একটি অব্যর্থ পাথেয় প্রদান করেছেন। আর সেটি হছে ইস্তিগফার। ইরশাদ হয়েছে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর দিকেই ফিরে যাও। তিনি তোমাদের এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত উত্তম জীবন উপভোগ করতে দেবেন। এবং যে কেউ বেশি আমল করবে তাকে নিজের পক্ষ থেকে বেশি প্রতিদান দেবেন। (সুরা হুদ ১১ : ৩)।
উল্লেখিত আয়াতে ইস্তিগফারের বিনিময়ে দুনিয়াতে উত্তম জীবন তথা নিরাপদ সুখময় জীবন লাভের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ইস্তিগফারকারীকে আল্লাহতায়ালা আজাব থেকে রক্ষা করবেন। ইরশাদ হয়েছে, (হে নবী!) আল্লাহ এমন নন যে তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান থাকা অবস্থায় তাদের শাস্তি দেবেন এবং তিনি এমনও নন যে তারা ইস্তিগফারে রত থাকা অবস্থায় তাদের শাস্তি দেবেন। (সুরা আনফাল ৮ : ৩৩)। ইস্তিগফারের মাধ্যমে ধনসম্পদে সমৃদ্ধি আসে। সন্তান-সন্ততিতে বরকত হয়। সুখময় নিরাপদ জীবনলাভের তৌফিক হয়। ইরশাদ হয়েছে, আমি তাদের বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চিতভাবে যেন তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করবেন। এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান আর নদ-নদীর ব্যবস্থা করে দেবেন। (সুরা নূহ ৭১ : ১০-১২)।
♦ লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর