শিরোনাম
রবিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে তবে নয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে

কাজী মোস্তাইন বিল্লাহ

তালগাছ নিয়ে কবিতা, ছড়া বা পদ্য রচনার লক্ষ্য নিয়ে ওপরের পঙ্ক্তি দুটির অনেক চমৎকার দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। রাস্তার পাশে তালগাছ লাগানোর অপরিকল্পিত উদ্যোগ দেখে নিজের অজান্তেই লাইন দুটি মাথায় গাঁট বাঁধে এবং সে জট একটু আলাদা করার চেষ্টা করেছি নিচের লাইনগুলোয়। আমার শৈশবে দেখা তালগাছটি এখনো চোখে ভেসে ওঠে সময়ে-অসময়ে। তেপান্তরের মাঠের এক প্রান্তে প্রায় আকাশছোঁয়া দৈর্ঘ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে তালগাছটি বিস্মিত করত আমাকে। আশপাশের অন্যান্য বৃক্ষকে ছাড়িয়ে একাকী আকাশ পানে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার এ অভিনব দৃশ্য আমার কাছে এমন একটা ম্যাজেস্ট্রিয়াল ব্যাপার ছিল যে আজও তালগাছকে রাজসিক বৃক্ষ বলেই মনে করি। তালগাছ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও মঈনুদ্দীনের তিনটি রচনাই বাংলা সাহিত্যে অতি পরিচিত। রবীন্দ্রনাথেরটি শিশুতোষ হলেও ভাবসমৃদ্ধ, নজরুলেরটি লঘু তালে রচিত। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনেরটি একদম শিশুতোষ; তালগাছ নিয়ে শুরু হলেও তালগাছনিবাসী বকপাখির কথাই প্রাধান্য পেয়েছে ছড়াটিতে। ছড়াটি একটু আবোল-তাবোল তো বটেই, তবে শব্দ-ধ্বনির জাদুতে এত সহজে স্মৃতিতে জায়গা করে নিয়েছিল যে আজও তা মুছে যায়নি। শব্দের সংগীতের এমন একটা মাধুর্য আছে যে তা একবার স্মৃতিতে দাগ কেটে ফেললে তার আঁচড় অত সহজে মিলিয়ে যায় না। এটি অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। তালগাছ নিয়ে আলোচনায় সে প্রসঙ্গ তুললে একটু বেতাল হওয়ার মতো হবে। মূল বিষয়ে ফেরা যাক। বাংলাদেশে মোট কতটি তালগাছ আছে তার কোনো গণনা কখনো হয়েছে কি না আমার জানা নেই। বার্ষিক শুমারিতে গোটা দেশের তালগাছের সংখ্যা গণনা বোধ করি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। তবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দৃষ্টির সমীক্ষায় সামগ্রিকভাবে তালগাছের সংখ্যা দেশে যে কমছে এমন বলাটা বোধহয় বেফাঁস বক্তব্য হবে না। আমার শৈশবের তালগাছটি তো হারিয়েই গেছে, বয়সের ভারে বা মানুষের আগ্রাসনে যে কারণেই হোক না কেন। অবশ্য তেপান্তরের সেই মাঠটিও তার অতীত রূপ হারিয়েছে, মানববসতি বা পথ-বাঁধা বা খাল খনন ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজের তোড়ে দৃষ্টি আর উধাও হয় না সেখানে। নানা বাধার দেয়ালে আটকে যায়। গ্রীষ্মের শেষ থেকে শরতের অনেকটা সময় ধরে কাঁচা এবং পাকা তাল বাজারে মেলে। কোথা থেকে আসে এর সরবরাহ? ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের পাশে বিশেষ করে কুমিল্লার নিকটবর্তী এলাকায় কোথাও কোথাও তালগাছের দু-চারটি সারি চোখে পড়ে। অন্যত্র কোথাও কি একাকী বা সারি করে ওরা প্রচুর সংখ্যায় দাঁড়িয়ে আছে? বাংলাদেশের কোথাও কি তালগাছের বিশেষ কনসেনট্রেশন আছে? স্থানীয় আবহাওয়া বা পরিবেশ কি নিয়ন্ত্রণ করে তালগাছের রোপণ ও লালন? জানা নেই। খুঁজে দেখার সুযোগও হয়নি। বাংলাদেশের সর্বত্র সহজভাবেই তালগাছ বাড়ে বলেই জানি। একসময় তালের জলযানও পাওয়া যেত। তার ব্যবহার কি একদম অচল হয়ে গেছে? সাম্প্রতিক সময়ে তালগাছ আলোচনায় এসেছে সমগ্র দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে। যেমন ২০২১-এ পর্যন্ত বজ্রপাতে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তার অধিকাংশই কৃষিকাজ বা ওই-জাতীয় খোলা জায়গায় কাজ করছিলেন। সংখ্যায় শতাধিক তো হবেই। এ প্রাণ হারানোর দুর্ঘটনা এড়াতে কেউ কেউ তালগাছের প্রসঙ্গ টেনে আক্ষেপ করে তালগাছের সংখ্যা হ্রাসের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাল রোপণের পরামর্শ দিয়েছেন। বজ্রপাত প্রথমে উঁচু মাথায় আঘাত করে এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করেন। ধারণাটা কতটুকু ঠিক বা বেঠিক তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না, তবে তালগাছ সম্ভবত বজ্রপাতের প্রতিষেধক নয়। তালগাছ রোপণ করে বজ্রপাত প্রতিহত সম্ভব এমন ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই তেমনটাই জেনেছি। লক্ষণীয় যে ইদানীং তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে, অনুমান করি প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায়। যেমন নির্মাণাধীন নতুন শহর পূর্বাচলের পাশ দিয়ে যে ৩০০ ফুট রাস্তা তৈরি হচ্ছে তার রোড ডিভাইডারে প্রচুর তাল-চারা উঁকি দিচ্ছে। অনেক জায়গায় একদম গায়ে গায়ে লেগে আছে ওরা। কেউ খেয়ালবশে ওগুলো লাগিয়েছেন মনে হয় না। অকারণ ইচ্ছার বশে এত চারা রোপণ করা একটু অসম্ভব বটে। তবে যার উদ্যোগেই লাগানো হোক, উদ্যোগটি আমার বিবেচনায় পরিকল্পনাহীন। একটি তালগাছ থেকে তার প্রতিবেশী গাছটির প্রয়োজনীয় দূরত্ব না থাকলে তা প্রতিটি গাছের জন্য যেমন ক্ষতিকারক, তেমনি নান্দনিকও নয়। একসময়ে গাছগুলো বড় হবে, পাতা ছড়াবে, তখন একটি গাছ যদি আর একটির ওপর পড়ে অথবা পাতায় পাতায় কান্ডে কান্ডে জড়িয়ে থাকে তাহলে দেখতে কি খুব সুখকর হবে? তা ছাড়া মাইলের পর মাইল তালগাছের সারি এক পায়ে দাঁড়িয়ে কি খুব সুখকর কোনো দৃশ্য তৈরি হবে? আমি তালগাছের অনুরাগী হলেও বৃক্ষের বৈচিত্র্যকে আরও স্বাগত জানাই। ‘বাতায়ন-পাশে গুবাক তরুর সারি’ দৃষ্টির জন্য সুখের হলেও সড়কমাঝে শত শত তালগাছের সারি কি খুব আনন্দবর্ধক হবে? তালগাছ যে নিঃসঙ্গ সৌন্দর্যের প্রতীক তা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটিতে সুস্পষ্ট। ঠিক কতটা দূরে একটি তালগাছ থেকে অন্যটি লাগানো উচিত তার ধারণা নিশ্চয়ই উদ্ভিদবিদ্যায় পাওয়া যাবে। সেই জ্ঞান বিবেচনায় এনে এবং মাইলের পর মাইল একঘেয়েভাবে তালবৃক্ষ না লাগিয়ে বৃক্ষরোপণ আরেকটু বৈচিত্র্যমুখী করলে আমার বিবেচনায় ভালো হয়। তালগাছ থাকুক একে অন্য থেকে দূরে দূরে, সারিতে অবশ্যই এবং তার মাঝে থাকুক অন্য বৃক্ষ। কাঁধে কাঁধ না মিলিয়ে তালগাছকে একা একা এবং একটু দূরে দূরে দাঁড়াতে দিলে গাছের স্বাস্থ্য ও সার্বিক নান্দনিকতা দুটোই রক্ষিত হবে বলে মনে করি।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব লিবারেল আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসের ডিন।

 

সর্বশেষ খবর