রবিবার, ২২ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা : কাড়ছে প্রাণ, বাড়ছে পঙ্গুত্ব

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা : কাড়ছে প্রাণ, বাড়ছে পঙ্গুত্ব

২৬ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সংবাদ-মাধ্যমে প্রচারিত দুর্ঘটনার খবরের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ

যাত্রীকল্যাণ সমিতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, এবারের ঈদযাত্রায় মোট ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত ও আহত হয়েছেন অন্তত ১১০ জন। এ হিসাব মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪.০৮ শতাংশ এবং দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৩৪.৮৫ শতাংশ ও আহতের প্রায় ১৩.০৩ শতাংশ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত সারা দেশে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫৬ জন, যা মোট নিহতের ৪১.৪৮ শতাংশ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণ বলছে, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ১৬.১৯ শতাংশ। মোটর-সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১.৯৫ শতাংশ। অন্য যানবাহনের মোটরসাইকেলে ধাক্কা বা চাপায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯.০৪ শতাংশ। অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২.৮ শতাংশ। নিয়ন্ত্রণহীন মোটরসাইকেল। বেপরোয়া এদের চালকরা। নিয়মকানুন ও ট্রাফিক আইন মানতে অনীহা অধিকাংশের। ফলে যত্রতত্র দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় অনেকে মারা যাচ্ছেন। অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। এমনিতেই আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তরফে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিলে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৩ জন নিহত ও ৬১২ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৬ জন। এ পরিসংখ্যানে থেকে দেখা যাচ্ছে, মোট দুর্ঘটনার ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং নিহতের ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশের কারণ মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও তাতে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। সংগত কারণে এ দুর্ঘটনা ও মৃত্যু রোখার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। কী কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা জরুরি। দেখা যায়, মোটর-সাইকেল চালকের একটা বড় অংশ টিনেজার। এরা নিয়মনীতি ও ট্রাফিক আইনের ধার ধারে না। এক মোটর-সাইকেলে দুজন-তিনজন পর্যন্ত চড়ে। হেলমেট পর্যন্ত ব্যবহার করে না। মোটর -সাইকেল রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটা বেড়েছে। উদ্ধত, বেপরোয়া ও উচ্ছৃঙ্খল টিনেজারদের মোটরসাইকেল নিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া তাই এখন সাধারণ ঘটনা। উপরন্তু কয়েক বছর হলো মোটরসাইকেলের অ্যাপভিত্তিক সার্ভিস চালু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুন ও নিয়ন্ত্রণ নেই।

দেশে মোট কত মোটরসাইকেল চলাচল করে তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। সারা দেশে নিবন্ধিত মোটর-সাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৮। এর বাইরে অনিবন্ধিত মোটর-সাইকেলও রয়েছে। এ সংখ্যা আরও কয়েক লাখ হতে পারে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল কেনা যাবে না, এমন বিধি থাকলেও এখন তা কার্যকর নেই। ফলে যে কেউ লাইসেন্স থাক বা না থাক মোটরসাইকেল কিনতে পারছে। এতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মোটরসাইকেল ড্রাইভিং জানে না এরূপ লোকের হাতে গিয়ে পড়ছে। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য যেরূপ দক্ষতা প্রয়োজন তা তাদের নেই। ফলে যে কোনো সময় তাদের দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, লাইসেন্স করা ৯ লাখ ১৪ হাজার ৮১৭টি মোটরসাইকেল ঢাকা শহরে চলাচল করছে। লাইসেন্স ছাড়া কত মোটরসাইকেল চলাচল করছে তা কেউ বলতে পারে না। রিকশার দৌরাত্ম্যে ঢাকা শহরে যাতায়াত করা যায় না। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মোটরসাইকেল। এ দ্বিচক্র যন্ত্রযান যানজটের এ শহরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা দিলেও দুর্ঘটনার ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ঈদের ছুটির সময় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৪৭ জন। এর প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। মোটরসাইকেল অনেক সময় যানজটেরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঢাকাসহ সড়ক-মহাসড়ক, এমনকি গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত মোটরসাইকেলের আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। মোটরসাইকেল একটি যন্ত্রবিশেষ। এর কোনো দোষ নেই। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য দায়ী এর চালকরা এবং ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মোটরসাইকেল চালনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। মোটরসাইকেল যে-ই চালাবে তার ক্ষেত্রে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। ট্রাফিক আইন ও বিধি যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল সার্ভিসকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার আওতায় আনতে হবে। এদের চালকদের উপযুক্ত দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরে কতসংখ্যক মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এক এলাকার মোটর-সাইকেল যাতে অন্য এলাকায় যেতে না পারে তা-ও দেখতে হবে। মোট কথা, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি রোধ করা যাবে না। মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ঝুঁকি কমাতে হলে ব্যক্তিগত ও সরকারি উভয় পক্ষে কতগুলো দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। মোটর-সাইকেল চালকদেরই বুঝতে হবে ট্রাফিক আইনের সব বিধান মেনে সতর্কতার সঙ্গে মোটরসাইকেল না চালালে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে দুর্ঘটনার প্রথম শিকার নিজেকেই হতে হয়। অঙ্গহানির আশঙ্কা থাকে, যাতে সারা জীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারাতে হতে পারে। দ্বিতীয়ত, মোটরসাইকেল চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলা নিশ্চিত করতে ট্রাফিক পুলিশকে তৎপর হতে হবে। লাইসেন্সহীন ও ত্রুটিপূর্ণ মোটর-সাইকেল চালানো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। মোটরসাইকেলের চালক ও অন্য আরোহীকে অবশ্যই হেলমেট পরতে হবে; ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। বেপরোয়াভাবে মোটর-সাইকেল চালানো যাবে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ।

সর্বশেষ খবর