সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য খাত আর গণমানুষের দারিদ্র্য

খায়রুল কবীর খোকন

স্বাস্থ্য খাত আর গণমানুষের দারিদ্র্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির মেধাবী শিক্ষক প্রফেসর আবুল বারকাত আন্তর্জাতিকমানের গবেষক। তার রাজনৈতিক-দৃষ্টিভঙ্গির অনেক কিছুর সঙ্গেই এবং অন্য-সব বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। তবে তিনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক। তাঁর বক্তব্যের অনেক কিছুর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেও এ কথা অকাতরে স্বীকার করবেন সবাই-তিনি এই দেশের গণমানুষের অর্থনীতির একজন অদম্য পরিশ্রমী ও আত্মত্যাগী গবেষক; সেটার প্রমাণ তিনি দিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। নিজের সহধর্মিণী প্রফেসর ডা. সাহিদা আখতারকে তাঁর ক্যান্সার-আক্রান্ত জীবনের শেষ-প্রান্তে শয্যাশায়ী রেখেও, ড. আবুল বারকাত রাত-দিন আহার-নিদ্রার সময়-রুটিন গোলমাল করে দিয়ে তাঁর গবেষণা-কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন প্রচন্ড দৃঢ়তায়। তিনি করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যেও, নিজের দুর্বল-শরীরের কষ্ট নিয়ে প্রচন্ড দুঃসাহসী ছিলেন তাঁর সর্বশেষ গবেষণা-কাজ সম্পাদনে। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বিশালকায় গবেষণাগ্রন্থ ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র : ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে।’ ২০২০ সালে সেই করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ দিনগুলোর মধ্যেই প্রকাশিত হয় এই গণমানুষের অর্থনীতির অসামান্য এক গবেষণা-দলিল। (অত্যন্ত বেদনার খবর-বইটির অন্যতম প্রকাশক এবং গণমানুষের অর্থনীতিবিদ-বারকাতের জীবনসঙ্গী প্রফেসর ডা. সাহিদা আখতার এই বইটি প্রকাশের বছরকালের মধ্যেই সেই গুরুতর-ব্যাধির কাছে হার মানতে বাধ্য হন, অকালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। অসামান্য মানবদরদি এক চিকিৎসাবিদ এবং দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব ডা. সাহিদা আখতার বারডেম হাসপাতালের প্রফেসর ছিলেন। দেশ হারালো এক অসাধারণ গণমানুষ-বন্ধু চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞকে)।

প্রায় পৌনে সাত শ পাতার এবং প্রায় পৌনে তিন লাখ শব্দের এই গবেষণা-বইটিতে আমাদের রাষ্ট্রের গণমানুষের তথা সারা বিশ্বের মানবসমাজের প্রতিটি সদস্যের জীবনযাপন কষ্টের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, শোষক ও শোষিতের আসল চরিত্র ও প্রাসঙ্গিক সমাজ-সংকটের বিচিত্র-চিত্রের নানা-বিষয়। আলোচিত ও মূল্যায়িত হয়েছে, অসামান্য সব মন্তব্য ও অভিমত দেওয়া হয়েছে। এই নিবন্ধে শুধু বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাত নিয়েই আলোচনা করা হচ্ছে।

এই বইয়ের স্বাস্থ্য খাত বিষয়ক অনুচ্ছেদে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের দশা ‘মহাদুর্দশাগ্রস্ত’ মন্তব্য করে বলা হয়েছে, “জনগণের জন্য ‘ভিক্ষাসম’ স্বাস্থ্য খাতে আমাদের সরকারি বরাদ্দ বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৮৮তম অর্থাৎ সর্বনিম্নে (আমাদের পরে আছে শুধু পাপুয়া নিউগিনি); স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মাত্র ২.৪  শতাংশের সমপরিমাণ। অথচ জনগণের স্বাস্থ্য রাষ্ট্র দেখবে বলে সংবিধান অঙ্গীকার করছে।’’

একই পাতার শেষাংশে আছে-‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল-অসংক্রামক (ক্রনিক অ্যান্ড এক্সপেন্সিভ নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ) রোগের বিস্তৃতি ও চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয়ের উচ্চহারের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ অদরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যান।’’

বইটির ৩৫০ পাতায় ‘দেশবাসীর স্বাস্থ্য ও মন কোনোটাই ভালো নেই’ মন্তব্য করে বলা হয়েছে : ‘‘১. ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৯ কোটি মানুষ সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকে কার্যত বঞ্চিত। ২. প্রতি বছর যে ৯ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন তার অর্ধেকই ৫ অথবা কম বয়সের শিশু। আরও লজ্জাজনক কথা, ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ দারিদ্র্য-উদ্ভূত। নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় মাথাপিছু ব্যয় মাত্র ১৩ টাকা, ডায়রিয়ায় ১৭ টাকা, হামে ১২ টাকা এবং যক্ষ্মায় ৯০০ টাকা। উল্লেখ্য, যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান এখনো অনেক ওপরের দিকে। ৩. প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষ সুপেয় পানির অভাবে মরণব্যাধি আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন। ধনীদের তুলনায় দরিদ্র মানুষের আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ১১ গুণ বেশি। ৪. প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ হাইপারটেনশন-এ ভোগেন বয়স্কদের মধ্যে ৬০ শতাংশ বা বেশি। ৫. প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিস রোগী। ৬. প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ ক্রনিক কিডনি রোগে ভোগেন। ৭. প্রায় ১৮-২০ লাখ মানুষ হার্টের সমস্যায় ভোগেন। ৮. প্রায় দেড় কোটি মানুষের আছে থাইরয়েড সমস্যা। ৯. প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ক্যান্সারে ভোগেন। স্তন ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা হবে আনুমানিক ২৩ লাখ। ১০. প্রায় ২.৫-৩ কোটি মানুষের আছে অস্টিও-আরথ্রাইটিস। ১১. প্রায় দেড় কোটি মানুষ ভোগেন সিওপিডিসহ অ্যাজমায়।”

মুক্তিযোদ্ধা আবুল বারকাত বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের রক্ষক-দাবিদার ক্ষমতাসীন পক্ষের একনিষ্ঠ সমর্থক (তবে সব ধরনের মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িতা লালন-পোষণের ঘোরবিরোধী) বুদ্ধিজীবী গবেষক হিসেবে কখনই বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যর্থতাগুলোর ইতিবাচক ও যুক্তিসিদ্ধ, তথ্যসমৃদ্ধ সমালোচনার বিপক্ষে যাবেন না অবশ্যই, তিনি তা করতেই পারেন না। সেই-তিনি যখন এই সরকারের স্বাস্থ্য খাতে ব্যর্থতার এই ‘করুণ-চিত্র’ লিপিবদ্ধ করেন তাঁর অত্যন্ত শ্রমসাধ্য গবেষণা গ্রন্থে তখন তো আর কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ লাগে না, আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা সাড়ে ১৩ বছরের ‘অপরিসীম’ উন্নয়ন কর্মকান্ডের অন্তঃসারশূন্যতার ব্যাপারে। এর পাশাপাশি আরও ভয়াবহ চিত্র পাচ্ছি আমরা সাম্প্রতিক আরেক রিপোর্টে। ১৫ জুলাই শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় প্রথম পাতায় শীর্ষ-শিরোনাম রিপোর্ট হচ্ছে-‘স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারে না ৭৩% মানুষ।’ বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মানুষ তাদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্যকর খাবারের ২৭৬ টাকা জোগাড় করতে অক্ষম। জাতিসংঘসহ পাঁচটি বৈশ্বিক সংস্থার রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।          

সম্প্রতি ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই পাঁচ সংস্থার প্রতিবেদন বলছে-‘২০১৯ সালে স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হতো ২৭২ টাকা ১৬ পয়সা। ওই সময় দেশের ১১ কোটি ৯৮ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। ২০২০ সালে দৈনিক স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য খরচ বেড়ে হয় ২৭৫ টাকা ৭৬ পয়সা। কিন্তু দেশের ১২ কোটি ১১ লাখ মানুষের দৈনিক ওই পরিমাণ টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। এই সামর্থ্যহীন মানুষ মোট জনসংখ্যার ৭৩.৫ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের ওই গবেষণা গ্রন্থ এবং পাঁচ বিশ্ব সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ দেয় এই দেশে স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসা কার্যক্রম নিদারুণ দুরবস্থায় রয়েছে। অপুষ্টি-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এই দেশে সত্তর শতাংশের বেশি, প্রায় ১৫ কোটি মানুষ যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তারা সবাই-ই রোগে-শোকে ভুগে ভুগে দিশাহারা।

তাহলে আওয়ামী লীগের একটানা সাড়ে ১৩ বছরের ক্ষমতাসীন থাকাকালের ‘অপরিসীম’ উন্নয়নের সুফল কোথায় গেল! এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অদক্ষতা ও দুর্নীতির ফলে সড়ক দুর্ঘটনা অবিরাম বেড়ে চলায় প্রচুর সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে অকালে। আহত ও পঙ্গু হচ্ছে অসংখ্য মানুষ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে অনেকে খুনোখুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন, আহত ও পঙ্গু হচ্ছেন। হতাশাজনক পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আত্মহত্যা প্রবণতাও বাড়ছে। এ সবই সরকারের সুশাসন দিতে না-পারার ব্যর্থতার কারণে।

গণতন্ত্রহীন দশায় কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাধরদের ব্যর্থতার মাত্রা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে, এ অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি চায়, প্রকৃত গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর