সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

এশিয়ার অপ্রত্যাশিত সাফল্যগাথা বাংলাদেশ

ওয়াহিদা আক্তার

এশিয়ার অপ্রত্যাশিত সাফল্যগাথা বাংলাদেশ

১৯৭৩ সালে একটি অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন থেকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের ভাগ্যোন্নয়নের পরামর্শদাতা হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ আয়োজিত কনফারেন্সে যোগ দিতে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, নরওয়ে, জাপান এবং ইন্ডিয়া থেকে দুই ডজন দিকপাল অর্থনীতিবিদ এসেছিলেন।  উদ্যোক্তা আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন স্বনামখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান এবং বাংলাদেশের প্রথম প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (BIDS) ওই কনফারেন্সে পেপার উপস্থাপন করে। সমাবেশটি ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণের জন্য ছিল একটি মাইলফলক।

দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ তখন অর্থনৈতিকভাবে এতটাই অসচ্ছল ছিল যে, ব্যয়বহুল এই কনফারেন্সটি আয়োজন করতে নিউইয়র্কভিত্তিক বিদেশি সংস্থা ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের (IEA) বিশেষ মঞ্জুরি সহায়তা নিতে হয়েছিল। কারণ মাত্র এক বছর আগে শূন্য রিজার্ভ নিয়ে সদ্যোজাত দেশটি যাত্রা শুরু করেছিল। এই পরিস্থিতিতেই ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার তার বিতর্কিত উক্তিটি করেছিলেন ‘বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ঝুড়ি’। উচ্চমূল্যে আয়োজিত এই কনফারেন্স শেষে তারা বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক শীতল কিছু মন্তব্য রেখে যান বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই পাওয়া রক্তস্নাত সদ্যোজাত দুর্বল, যুদ্ধবিধ্বস্ত, চরম দারিদ্র্যপীড়িত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্য।

বিদেশি অর্থনীতিবিদদের বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল, বাংলাদেশের ভবিতব্য নিয়ে কী বলেছিলেন সেদিন, ফিরে দেখি সেই দিনগুলো। ক্যামব্রিজ অর্থনীতিবিদ অস্টিন রবিনসন এই কনফারেন্সে যোগ দিয়ে সদ্যোজাত দেশটির দুর্দশার চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেছিলেন, সরকার অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে অসংখ্য দৈনন্দিন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার মধ্যে চরম খাদ্য সংকট, বিধ্বস্ত পরিবহন ব্যবস্থা, রিজার্ভ শূন্যতা, বৈদেশিক বাণিজ্যের ভঙ্গুর দশা। এভাবে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্র আঁকেন। অর্থনৈতিক অবস্থা এতই ভঙ্গুর ছিল যে, তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন সদ্যোজাত বাংলাদেশটি বাঁচবে কি না! বহু জ্ঞানী ও অর্থনীতির বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, পৃথিবীতে বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর একটি অকার্যকর দেশ হয়ে টিকে থাকবে। কেউ কেউ ম্যালথেসিয়ান দুঃস্বপ্ন হিসেবে অভিহিত করেন এর জনসংখ্যা স্ফীতি ও খাদ্য উৎপাদনের অপ্রতুলতার জন্য। ইউএস অর্থনীতিবিদ Hollis B. chenery যিনি ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের প্রবক্তা ছিলেন এবং ১০ বছর বিশ্বব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ওই কনফারেন্সে যোগ দেন আন্তর্জাতিক সংস্কার ও উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিনিধি (IBRD) হিসেবে, তিনি বাংলাদেশের ভবিতব্য লিখতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ১২৫ বছর প্রয়োজন হবে এর জনগণের মাথাপিছু আয় ৭০ ডলার থেকে ৯০০ ডলারে পৌঁছতে। সেই দুঃখের দিন চলে গেছে, বাংলাদেশের ৫২ বছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২৮২৪ ডলার। বাংলাদেশ পৃথিবীকে এখন ভিন্ন গল্প শোনাচ্ছে। সেই গল্প উন্নয়নের, সেই গল্প বহুক্ষেত্রে সফলতার। অর্থনীতিবিদ chenery’র ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ এখন অন্যান্য দেশের জন্য উন্নয়নের মডেল’। উদাহরণ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর উক্তিটি নেওয়া হলো। Bangladesh has become one of Asia's most remarkable and unexpected success stories in recent years. ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে তিনি লিখেছেন- As a result of progressive social polices and a bit of historical luck Bangladesh has gone from being one of poorest countries in south Asia to an aspring 'Tiger' economy. এই প্রশংসাসূচক মন্তব্য শুধু কথার কথা নয়। নোবেলপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতাকে প্রশংসা করেছেন। প্রান্তিক জনগণের উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নে ভারত সরকারকে তিনি বাংলাদেশকে অনুসরণ করার জন্য বলেছেন। কলকাতা প্রেস ক্লাবে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে’। ২০১৫ সালের ১৭ জুন ইউএস রিপোর্টে গ্লোবাল হাঙ্গার বাংলাদেশকে উদ্ধৃতি দিয়েছে এবং একই বছর ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর এক রিপোর্টে বলেছে, ‘ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়তে বাংলাদেশ বিশ্বের মডেল হতে পারে।’ ‘Today, the one time food basket case has transformed into something at a food basket and a model for hunger reduction for the rest of the world |’ বাংলাদেশ এশিয়ার অপ্রত্যাশিত সাফল্যগাথা। আমাদের পূর্বপুরুষরা সমৃদ্ধ ছিলেন, ব্রিটিশ শাসন ও ২৩ বছরের বৈষম্যমূলক পাকিস্তানি শাসন আমাদের দারিদ্র্যের চরম সীমায় পৌঁছে দেয়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর দূরদর্শী মহান নেতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের মাটি আছে, মানুষ আছে। বাংলাদেশের সেই মানুষরা অদম্য সাহস ও শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেদের দেশের উৎপাদন বাড়িয়ে পৃথিবীতে সামনের কাতারে এসেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নচিত্র ১৯৭৩ সালের কনফারেন্সে আসা অর্থনীতিবিদদের ভুল প্রমাণিত করেছে। তবে যুগোস্লাভিয়ার ইকোনমিস্ট Branko Hovart, ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক সায়েন্স অব যুগোস্লাভিয়ার সেই কনফারেন্সে সোশ্যালিস্ট সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে বলেন, বাংলাদেশ ৮% হারে প্রতি বছর গ্রোথ অর্জন করতে পারে। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন একমত পোষণ করেছিলেন কি না জানা যায় না। তবে ক্যামব্রিজ ইকোনমিস্টসহ রবিনসন ভিন্নমত পোষণ করে তাঁর নেতিবাচক মন্তব্যে অটল থাকেন। আমি দেশটির চরম দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের কোনো উপায় দেখছি না। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি উদ্বেগজনক। দুই বছর আগে কৌশিক বসু যিনি বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ ম্যালথাসের তত্ত্বের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনায়। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম একটি চরম দরিদ্রতম দেশ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উদীয়মান অর্থনীতির শীর্ষে অবস্থান করছে। রবিনসনসের উক্তির উত্তম জবাব দিয়েছেন কৌশিক বসু। সময়ের পরিক্রমায় রবিনসনসের মতামত ভুল প্রমাণিত এবং Branko যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা মানুষের হৃদয়ের অদম্য সাহসিকতা অনুমান করে হয়তো আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী আজ সত্য হয়েছে ‘আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না’।

বাংলাদেশ এখন LDCs থেকে উত্তরণ হয়েছে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ আমাদের উন্নয়ন গাথার অংশীদার হয়ে গর্ববোধ করে। তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সুন্দর ছবি আঁকে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাংলাদেশে নিজস্ব অর্থায়নে শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নামে নিজস্ব স্যাটেলাইট মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ, ঢাকার বুকে মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবতা, কর্ণফুলীতে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অচিরেই চালু হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই অর্জন সহজ ছিল না। অনেক বাধা, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখেছেন গত দেড় দশক ধরে দায়িত্বে আসীন বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রেডিমেড গার্মেন্ট, বাংলার কৃষি, বাংলাদেশের সন্তানদের পাঠানো কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স, দানা জাতীয় খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক সংকটে ইউরোপজুড়ে মূল্যস্ফীতি, বিপর্যস্ত ব্রিটিশ নাগরিকদের জীবন। কদিন আগেই মূল্যস্ফীতি বিগত ৪২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সেবার বিনিময়ে চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে সব দেশের অভিভাবকদের। আমাদের একজন অভিভাবক আছেন। পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্রনেতা বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেতা হিসেবে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে যার নাম উচ্চারণ করেন তিনি বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের অভিভাবক শেখ হাসিনা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও কভিড-পরবর্তী সংকটে উন্নত বিশ্বের অর্থনীতি যেখানে হেলে পড়েছে সেখানে আমাদের অনেকে স্রেফ গুজবের ওপর ভিত্তি করে এটা কেন হলো না, ওটা কেন হলো না বলে দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে তৎপর রয়েছে।

Nicholas Kristof আমেরিকান সাংবাদিক। যিনি দুবার পুলিৎজার পুরস্কার পান। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় তিনি নিউইয়র্ক টাইমসে কলাম লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘Bangladesh is a country full of misfortune’ অর্থাৎ দুর্ভাগ্যের প্রাচুর্যে ভরা একটি দেশ বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছর পূর্তিতে তিনি পুনরায় গত তিন দশকের বাংলাদেশের অভাবিত অগ্রগতি দেখে বলেন, ‘আমি যে মন্তব্য লিখেছিলাম তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। এক সময় যে দেশ ছিল হতাশার অপর নাম, এখন তা বিশ্বকে শেখাতে পারে কীভাবে সামনে এগোতে হয়।’  সর্বশেষ ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট কর্তৃক ‘The top heavy global economy’ শিরোনামে প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৩৫তম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ।

পৃথিবীতে এমন কোনো হতাশা জন্ম নেয়নি যা আশা ও আত্মবিশ্বাস অতিক্রম করতে পারেনি। আশা হলো এমন একটি বিশ্বাস, যা মানুষকে অর্জনের দিকে নিয়ে যায়। আশা আর আত্মবিশ্বাস ছাড়া কিছুই সম্ভব হয় না। যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আশা করেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর দেশের মাটি ও মানুষ সোনার বাংলা গড়বে। সেই স্বপ্ন আজ সার্থক হয়েছে। পৃথিবীর সব বড় অর্জন সেসব মানুষের দ্বারা হয়েছে, যারা কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও আশা নিয়ে চেষ্টা করে গেছেন।  আশা কখনো মিথ্যা হয় না, আর যেখানে লক্ষ্য নেই সেখানে আশাও নেই। আমরা এই আশা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশকে একটি উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাব। ইনশাআল্লাহ্।

                লেখক : সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়

সর্বশেষ খবর