২০২৪ সালের জুলাই মাসের শেষ ১৫ দিন এবং আগস্ট মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং দেশে যা ঘটেছে তার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমাদের বয়সি মানুষেরা তাঁদের জীবনসায়াহ্ন অবধি স্মরণে রাখবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ঢাকায় বসবাসকারী লক্ষ কোটি মানুষ এক অভূতপূর্ব গণবিপ্লব তথা গণ অভ্যুত্থানকে প্রত্যক্ষ করেছে। একে বলা হচ্ছে জুলাই বিপ্লব, আবার কেউ কেউ আগস্ট বিপ্লব বলেও আখ্যায়িত করছেন। জানি না অনাগত ভবিষ্যৎ কোনটাকে স্বীকৃতি দেবে। যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণ দেখেছে, ৭ মার্চ ’৭১ দেখেছে, ‘৯০ সালের সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী গণ আন্দোলনের স্বরূপ দেখেছে, শুধু তারাই বলতে পারবে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কতটা তীব্র ও বাঁধভাঙা ছিল। বলা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অতীত ইতিহাসে লিপিবদ্ধ সবকিছুকে ছাপিয়ে এমন অকল্পনীয় জনতার সংঘবদ্ধ বিস্ফোরণ, ক্ষুব্ধ অগ্নিমূর্তি আর গণজাগরণ অন্য কোথাও এত ব্যাপকতা নিয়ে জেগে ওঠেনি। যেন হঠাৎ জেগে ওঠা দাবানল থেকে তারুণ্যের নেতৃত্বের এমনতর গ্রহণযোগ্যতা, প্রতিবাদের ভাষা, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার দুর্দান্ত স্পর্ধা আগে এ জনপদে কেউ দেখেনি। শৃঙ্খলা বাহিনীর আধুনিক মারণাস্ত্রের বুলেটের বিপরীতে একসঙ্গে মৃত্যুর শপথ, ইস্পাত কঠিন দৃঢ় বন্ধন, একসঙ্গে লক্ষ কোটি জনতার অন্তহীন মিছিল দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারিনি। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, গণমানুষের এমন দীর্ঘ মিছিল এর আগে রাজধানী ঢাকা কখনো দেখেনি। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব বা ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সময়ও রাজপথে এমন কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বলে মনে হয় না। এমনকি ১৯৩৪-৩৬ সালের চীনের কিংবদন্তি নেতা কমরেড মাও সে তুং-এর লং মার্চে অংশ নেওয়া বাহিনীর সংখ্যা ছিল লাখের কম। ১৯৪৭ সালেও উপমহাদেশের কোনো শহরে এত বিপুল জনতা একসঙ্গে নেমে আসেনি। তাছাড়া তৎকালীন পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যার বিচারেও রাজপথে এমন বিপুলসংখ্যক জনতার কথা ভাবা যায় না।
দুই.
৫ আগস্ট ২০২৪।
সেদিন শাহবাগের সাকুরা রেস্তোরাঁর পাশে অন্তত ৩০ ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে লক্ষ মানুষের চলমান মাথা দেখে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। জনতাই যেন সব ক্ষমতা। কে রুখে দাঁড়াবে, কার বিপক্ষে কে? কোথাকার এ মানুষ, এর উৎসমুখ কোথায়, যাচ্ছে কোথায়, এর শেষ কোথায়? এমন সব প্রশ্ন এসে মাথায় ভিড় করছিল। তাদের মুখের একটা সেøাগান এখনো কানে বাজে- ‘চল চল চল, গণভবনে চল’। এ অনিঃশেষ পদযাত্রায় অংশ নেওয়া শতকরা ৮০ ভাগ জনতা ছিল তরুণ এবং নেতৃত্বহীন। সেখানে কেউ-ই কর্মী নন, সবাই নেতা। যেন ‘সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। কে কাকে অনুসরণ করছে জানা নেই। এদের গন্তব্য প্রায় অনিশ্চিত। এরা কেউ উদ্বিগ্ন নন, মুখে শঙ্কার ছাপ নেই। বরং নির্ভয়ের আভা ছড়িয়ে হাস্যোজ্জল অঙ্গভঙ্গিতে সেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিমূল থেকে শাহবাগ চত্বর হয়ে বাংলামোটর, সোনারগাঁও, ফার্মগেট, সংসদ ভবনের দিকে অগ্রসরমান। হঠাৎ বন্যায় বাঁধ ভাঙা জলের মতো এক গর্জে ওঠা জনস্রোত।
একজন ষাটোর্ধ্ব প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিপাতে বলছি, এরা ছিল নিরস্ত্র, নির্বাধ, স্বতঃস্ফূর্ত। কারও কারও হাতে বাংলাদেশের পতাকার ক্ষুদ্রাংশ দেখেছি। মুষ্টিমেয় জনতার হাতে কুড়িয়ে পাওয়া লাঠি বা ডালজাতীয় অস্ত্র দেখা গেছে। দেখেছি অপেক্ষাকৃত তরুণ বাবারা তাদের স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে মিছিলের সাথী হয়েছে। সেদিনের উত্তাল গতিময়তায় আরও একটা বিষয় অনেকের নজর কাড়ে, কিছু তরুণ রাস্তার পাশ থেকে মিনারেল ওয়াটার, শুকনা খাবার এবং ছোট ছোট বিস্কুটের প্যাকেট জনতার দিকে ছুড়ে মারছিল। জনতাও হর্ষধ্বনিতে লুফে নিচ্ছিল। তবে সরবরাহকারী কারা জানা যায়নি। তারা আড়ালে ছিল। টোকাই শ্রেণির কতিপয় মুখ বারবার সে খাবার সংগ্রহ করছিল। তারা নিজের কাছে জমা করছিল।
তিন.
সেদিনই আমার চিকিৎসকপুত্র বিনাবাক্যে হঠাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাবাকে কিছু না বলে সে কখনো বাইরে যায় না। কেবল সেদিন ব্যতিক্রম হলো। বলা যায়, ছেলের পিছু ধরে হাঁটতে গিয়েই স্মরণকালের বৃহত্তম গণবিক্ষোভ ও জন অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হই। আরও একবার সাক্ষী হয়ে থাকলাম এক টুকরো মানব ইতিহাসের এবং অনাগত কালের জন্য লিপিবদ্ধ হয়ে থাকা গণমানুষের সংক্ষুব্ধতার এক নব উপাখ্যানের সঙ্গে। সেদিন বেলা ১১টা থেকে অন্তত চার ঘণ্টাব্যাপী ঢলনামা মানুষের মিছিল দেখেছি। এটা কেবল শাহবাগ টু ফার্মগেট রোডের দৃশ্য। সেদিন ঢাকার অন্য কোনো রাস্তায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। গভীর অভিনিবেশ নিয়ে লক্ষ করছিলাম, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে সুপ্রিম আর্মফোর্সেস বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সবাই নজিরবিহীন নির্বিকার হয়ে জনতার অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে তাঁদের হাত তুলে স্বাগত জানাচ্ছেন। তরুণরা এদের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে সদানন্দে সেলফি সেশন করে চলেছে। কোনো বাধা নেই, আপত্তি নেই, সিপাহি জনতা ভাই ভাই পরিবেশ। এক পর্যায়ে মিছিলের মধ্যে ঢুকে পড়ে নানাপন্থি নানাবিধ দুষ্কর্মকারীরাও। তারা পথের ধারের বিভিন্ন স্থাপনায় এমনকি দু-চারটি আবাসিক ভবনেও অতর্কিত হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। শাহবাগের কাছে বোরাক টাওয়ার, রূপায়ণ টাওয়ারে প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। বলাবাহুল্য, যুগে যুগে এ শ্রেণিটাই অতিউৎসাহী এবং অবিমৃষ্যকারী। এদের কোনো দল-মত, নীতি-রীতি নেই। জীবন এদের কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ। সারাক্ষণ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই এরা মানুষের মাঝে ভেসে বেড়ায়। বেশির ভাগ এরাই গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, মূল্যবান গাড়ি, মার্কেট, শপিং মল ইত্যাদিতে ভাঙচুর এবং লুট করে। এরা এসবের মূল্য জানে না, গুরুত্ব বোঝে না, ব্যবহার দেখে না। এদের মধ্যে একই সঙ্গে আনন্দ, প্রতিহিংসা এবং নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিকতা কাজ করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে।
চার.
ছাত্ররা বয়সে তরুণ তবে মেধাবী, দেশপ্রেমিক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের অভিজ্ঞতার অভাব থাকতে পারে কিন্তু সততা, নিষ্ঠা ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে তারা অকুতোভয়, দৃঢ় এবং আপসহীন। সরকারি চাকরিতে মেধার কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ছয় তরুণ সমন্বয়কের কথা বলার কৌশল, আত্মবিশ্বাস, সাহস ও ত্যাগ সমগ্র জাতিকে বিস্মিত অভিভূত করেছে। দেশের মানুষ এমনকি শাসকগোষ্ঠী স্বপ্নেও ভাবেনি এ তরুণরা দেশে এমন অভ্যুত্থান ঘটাতে পারবে। মুহূর্তে সবকিছু ওলটপালট করে দিতে পারবে। এমন দুর্দ- প্রতাপশালী, দাম্ভিক, অভিজ্ঞ সরকারকে উৎখাত করতে পারবে।
বাস্তবতা হলো, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
আবু সাঈদের বীরোচিত আত্মত্যাগ, মুগ্ধ নামের নিষ্পাপ ছেলের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ, একে একে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চলেছে তরুণরা এবং পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার ধারাবাহিক প্রতিবাদ আর সরকারের সহযোগী বাহিনীর হাতে শতাধিক ছাত্র-জনতার হত্যাকান্ডের একপর্যায়ে তাদের প্রতি আস্থা, ভালোবাসা, সন্তানসম স্নেহময়তায় সেদিন সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে এসেছিল। বলা যায়, দেশের আপামর মানুষ প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে তাদের সমর্থন জুগিয়েছে। এ কথা সত্যি যে, সরকারের পরিবর্তন বিষয়ে পূর্ব থেকেই গণমানুষের মধ্যে একটি মানসিক প্রবণতা কাজ করে আসছিল। যা ৫ আগস্টের বিস্ফোরণের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
পাঁচ.
৫ আগস্ট, বিকাল ৩টা। সাড়ে পনেরো বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমাপ্তি টেনে সর্বদা তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদানকারী, মহা আবেগপ্রবণ, স্থায়ী ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা গণভবন থেকে পালালেন হেলিকপ্টারে করে। আশা ভরসা, স্থান ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
পরদিন দেশের বহুল আলোচিত এবং প্রচারিত দৈনিকগুলো শিরোনাম করে।
* রক্তসমুদ্রে স্বৈরাচারের পতন, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
* ছাত্র-জনতার বিজয়, হাসিনার বিদায়, প্রথম আলো।
* ছাত্র-জনতার বিজয়, ইত্তেফাক।
* ছাত্র-জনতার রক্তে ভেজা বিজয়, সমকাল।
স্বাধীন বাংলাদেশের আলো-বাতাসে সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যেতে চায়। অন্যায় অবিচার অবহেলা আর অশান্তির অবসান হোক।
♦ লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট