বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ১৭তম কারামুক্তি দিবস ১১ সেপ্টেম্বর। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে। তিনি ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান। এরপর থেকে মুক্তির এ দিনটিকে খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সফল ব্যক্তিত্ব। তিনি গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি আন্দোলনে সফল হয়েছেন। আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাণ। তিনি সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে তিন-তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ও মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী।
১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক বাহিনীর কতিপয় দুর্বৃত্তের হাতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদাতবরণ করার পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের আহ্বানে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে পার্টির চেয়ারপারসন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলত বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়।
১৯৮৩ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। বেগম জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩-এর সেপ্টেম্বর থেকে সাত দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে আট দল ও পাঁচ দল হয়। আট দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দল, পাঁচদলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া এরশাদ হটাও এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। পুনরায় শুরু হয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।
১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার কায়েম করে। ২ এপ্রিল তিনি সংসদে সরকারের পক্ষে এ বিল উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদকে স্বপদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল আনেন। ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালের সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিল পাস হয়। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে বেগম খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেওয়ার পর থেকে মোট পাঁচবার তিনি গ্রেপ্তার হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর প্রথম গ্রেপ্তার হন। এরপর ১৯৮৪ সালের ৩ মে দ্বিতীয়বার, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তৃতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার হন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে দুই ছেলেসহ গ্রেপ্তার হয়ে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি হাই কোর্টের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদন্ড দেন। ওইদিনই তাকে আদালতের পাশে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিত্যক্ত ওই কারাগারে একমাত্র বন্দি ছিলেন তিনি। কোনো অপরাধ না করেও শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বছরের পর বছর তাকে কারাবন্দি থাকতে হয়।
এ ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ২০১৫ সালে প্রায় তিন মাস তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ সরকার অবরুদ্ধ করে রাখে। নিরাপত্তার কথা বলে তালা মেরে দেওয়া হয় তার অফিসের গেটে। তার চলাফেরার পথ বন্ধ করার জন্য বাসার সামনে রাখা হয় বালুর ট্রাক।
শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ঘরবাড়ি ছাড়া করে। তার দুই ছেলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। তাদের নির্যাতনে আরাফাত রহমানের অকালমৃত্যু হয়। তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সফল ব্যক্তিত্ব। তার নেতৃত্বেই স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা বেইমানি করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের নয়নমণি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জনগণের পাশে থেকেছেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে বছরের পর বছর কারাবন্দি থেকেছেন, তবুও তিনি কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করেননি। নিজের কথার ওপর অটল থেকেছেন। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে রাজপথে নেমে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। খালেদা জিয়া যে আপসহীন নেত্রী তিনি বারবার সে বিষয়টির প্রমাণ দিয়েছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কারণে তিনি আজীবন বাংলাদেশের জনগণের মাথার মুকুট হয়ে থাকবেন। আর গণতন্ত্র হত্যা, হাজার হাজার বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীসহ ছাত্র-জনতা হত্যার কারণে শেখ হাসিনা ইতিহাসে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও সভাপতি গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপি। সাবেক প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ