একটা গণ অভ্যুত্থান হলো আমাদের দেশে। ৫ আগস্ট! অভ্যুত্থানটা এমনই যে, অভ্যুত্থানকারী ছাত্ররা আগস্ট নামটাই উচ্চারণ করতে চায় না, তারা লিখছে ৩৬ জুলাই! ঘৃণা থেকে! এই ঘৃণা, এই বিপ্লব, এই অভ্যুত্থান, এই রেনেসাঁ, এই রিফর্মেশন সিঙ্গাপুরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। কারণ আমরা শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমাদের দেশ সিঙ্গাপুরের মতো হবে! হবে বৈকি! যদিও ফ্যাসিবাদী শাসক এ কথা বলছিলেন, তবুও মনে হচ্ছে সেই বাস্তবায়নটা ফ্যাসিবাদী শাসক পতনের নায়কদের এবং বর্তমান বাংলাদেশের আলোর পথের দিশারীরূপী কান্ডারি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বারা বাস্তবায়ন হবে। আমরা আশাবাদী।
১৯৬৫ সাল, ৯ আগস্ট। সিঙ্গাপুরকে বের করে দেওয়া হলো ব্রিটিশ ক্রাউন কলোনির মালয় কমিউনিটি থেকে। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র উল্টো ঘটনা। সবাই স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে; আর এখানে তাদের বের করে স্বাধীন করে দেওয়া হলো। কী অপরাধ? সিঙ্গাপুর এলাকাটা দুর্নীতি এবং অপরাধপ্রবণ! এ কলঙ্ক যেন মালয় কমিউনিটিতে না লাগে সেজন্য। সিঙ্গাপুরের গভর্নর ছিলেন লি কুয়ান ইয়ে। বিশ্বের বড় বড় সাংবাদিকদের সামনে অঝোরে কেঁদেছিলেন এত বড় অপমান সইতে না পেরে। তিনি ছিলেন অক্সফোর্ড পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত এবং সজ্জন। তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল, যে অপরাধে তাদের বের করে দেওয়া হলো সেই কলঙ্ক তিনি চিরতরে দেশের গা থেকে মুছে ফেলবেন। তাতে যা হয় হবে! আমি সিঙ্গাপুরে ২৩ দিনের ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম। তাদের দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাকে আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করার জন্য। যে সিঙ্গাপুরে যায়নি তাকে বোঝানো যাবে না সিঙ্গাপুর দেশটা কেমন। কতখানি নিরাপদ! ২-৩ লাখ টাকা আর দামি ক্যামেরা নিয়ে নিশ্চিন্তে রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছি সেখানে। অথচ কোনো পুলিশ নেই! ২৩ দিনে শুধু একবার মেট্রোতে তাদের তিনজন পুলিশ আমার নজরে পড়ল। তাও তারা কোথায় যেন যাচ্ছিল, কোনো ডিউটি করছিল না। কীভাবে হলো এটা! ১৯৬৫ সালের সিঙ্গাপুর আর আমাদের ১৯৭১ সাল এবং তার পরবর্তী সময়ের চিত্র একই। সিঙ্গাপুরের ফিরে দাঁড়ানোর ইতিহাস জানার জন্য আমি শরণাপন্ন হলাম ডিরেক্টর ইস্থার বে-এর কাছে। আমি দলনেতা ছিলাম বলে তারা আমার কথা গুরুত্ব দিতেন খুব। তিনি আমাকে পাঠালেন ইতিহাস বিষয়ে তুলনামূলক বেশি অভিজ্ঞ সুন তাতস ফাহ-এর কাছে। তাঁর কাছ থেকেই পেলাম সিঙ্গাপুরের উন্নয়নের পেছনের ঘটনা। লি কুয়ান ইয়ে পর দিনই তাঁর গভর্নরস বোর্ডদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, যাদের কারণে তাঁর দেশের এ অপমান হয়েছে তাদের তিনি নির্মূল করবেন। প্রথমে বোর্ড রাজি না হলে লি কুয়ান ইয়ে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার কথা বললে গভর্নরস বোর্ড লি কুয়ান ইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়। তিনি দুর্নীতিবাজ এবং সন্ত্রাসীদের এক সপ্তাহ সময় দেন আত্মসমর্পণের। যারা আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের তিনি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র তৈরি করে দেন। বাকিদের এক রাতেই প্রায় নির্মূল করেন। তারপর থেকেই দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স রয়েছে সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুরের উন্নয়নের পেছনে এটি একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এর পরেই তিনি বিদেশি সব কোম্পানিকে বিনা শুল্কে এবং সব সুবিধা দিয়ে তাঁর দেশে কারখানা স্থাপন করার সুযোগ দেন। শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। কারিগরি শিক্ষাকে প্রধান শিক্ষায় পরিণত করেন। সিঙ্গাপুরের উত্থানের পেছনে এর নোডাল অবস্থানটাও অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেদিক থেকে আমাদের দেশও কম নয়, বিশেষত নোডাল এবং ভূরাজনীতির দিক থেকে! সিঙ্গাপুরের মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং শক্তিশালী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লিংক সিঙ্গাপুরকে এগিয়ে দেয় কয়েক ধাপ। (এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি আমার ‘আলোর দেশে প্রযুক্তির দেশে’ গ্রন্থে)।
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইয়ে ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং সজ্জন। আমাদের অভ্যুত্থানের পর আমরাও পেয়েছি একজন উচ্চশিক্ষিত এবং সজ্জন ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। এখন প্রয়োজন শুধু সংস্কার করার এবং শক্তভাবে দেশের হাল ধরার। বিগত ২০ বছরের সব দুর্নীতির সুষ্ঠু বিচার করা। দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স প্রদর্শন। সব ক্ষেত্র থেকে দুর্নীতিকে নির্মূল করা। বিদেশি সব কোম্পানিকে বিনা শুল্কে এবং সব রকম সুবিধা দিয়ে কারখানা স্থাপনের আহ্বান জানানো। দেশের জনগণকে জনশক্তিতে রূপান্তরের প্রচেষ্টা করা। এজন্য প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। আমি মনে করি সিঙ্গাপুরের চেয়েও আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারব। কারণ সিঙ্গাপুরে কোনো খনিজ সম্পদ নেই, জনসম্পদ খুবই কম, এমনকি সিঙ্গাপুরের লোকজনকে খাওয়ার পানি পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে আনতে হয়! সেখানে আমাদের দেশে অনেক অনেক সম্পদ আছে। খাদ্যে আমরা প্রায়ই স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেহেতু দুর্নীতি রুখতে পারলে আমাদের দেশ তরতর করে এগিয়ে যাবে। শত বছরের পরিকল্পনা করে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন করা হলেই সফলতা আমাদের কাছে ধরা দেবেই। বিগত ১৫ বছরে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে এবং যে পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে তা দিয়ে দেশের প্রতি ইঞ্চিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঢেকে ফেলা যেত। পেছনের দিকে তাকানোর এখন প্রয়োজন নেই। এখন প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন। তাহলেই সম্ভব দেশকে ১০ বছরের মধ্যেই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমাদের প্রত্যাশা, নতুন কান্ডারি আমাদের এখন সেদিকেই নিয়ে যাবেন, আমাদের দেখাবেন নতুন পথ। আমরা তাঁর পানে তাকিয়ে রয়েছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক