‘হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়/ ভাবনা কী আর তাতে ক্ষতি বলো কার?/ সেই তো ভালো মন যাহা চায়/ হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়।’ গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ ভাগে আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গানের প্রথম কয়েকটি কলি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক প্রয়াত নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমায় গানটি গেয়েছিলেন সেই সময়ের অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, ঠোঁট মিলিয়েছিলেন নায়করাজখ্যাত অভিনেতা রাজ্জাক। ১৯৬৯ সালের ১০ অক্টোবর সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। সে সময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত গানটি। আমরা বালকদল স্কুল থেকে ফেরার পথে গলা ছেড়ে গাইতাম, আর ভাবতাম, জীবনটা এমন হেসে খেলে পার করে দিতে পারলে কতই না মজা হতো! সঙ্গে যদি পরীক্ষা নামের পুলসেরাতটি না থাকত, তাহলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু সে পুলসেরাত পার না হয়ে সামনে এগোনো বা ওপরের সোপানে তো পা রাখার উপায় ছিল না। বছর শেষে পরীক্ষা নামের ভীতিকর দৈত্যটি এসে সামনে দাঁড়াত।
আসলে হেসে খেলে সময় কাটানোর নাম জীবন নয়। সে ফুরসতও নেই। জীবন অত্যন্ত জটিল একটি পথচলা। আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির সব মাখলুকাতের জীবন একটিই। সে মানুষই হোক কিংবা জীবজন্তু বা উদ্ভিদ। সবার জীবনেরই সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। পরম করুণাময়ের ইচ্ছার বাইরে এই পৃথিবীর একটি ধূলিকণারও নড়াচড়ার উপায় নেই। সব তাঁর বেঁধে দেওয়া নিয়মে চলে। প্রকৃতির মতো মানুষের জীবনও সৃষ্টিকর্তার নিয়মের জিঞ্জিরে বাঁধা। সেই নিয়মের মধ্যে থেকেই মানুষকে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এই এক জীবনে মানুষকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়। মাধ্যমিক ছাত্র থাকা অবস্থায় ‘ভ্যালু অব টাইম’ ইংরেজি রচনা পড়েছিলাম। তার শুরুতেই একটি বাক্য ছিল, ‘টাইম ইজ শর্ট বাট আর্ট ইজ লং’। এই বাক্যটির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ তখন পুরোপুরি উপলব্ধিতে আসেনি। পরে গ্রিক প্রবাদ থেকে উৎপত্তি হওয়া এ বাক্যটির মর্মার্থ অনুধাবনে সক্ষম হয়েছি। মানুষের জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কারও কারও জীবন সংক্ষিপ্ত হয় শিশুকালেই। কেউ যুবক বয়সে পাড়ি জমায় না ফেরার জগতে। ভাগ্যবানরা বেঁচে থাকেন অনেক দিন। কেউ ষাট, কেউ সত্তর, কেউ অশি, কেউ নব্বই পার করারও সৌভাগ্য অর্জন করেন। তবে সেঞ্চুরি করা মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। যারা সে ঘরে পৌঁছতে পারেন, তারা সংবাদের শিরোনাম হন। এই সীমিত সময়ের মধ্যেই মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাকে সম্পৃক্ত হতে হয়। ভেবে দেখুন একটি ছোট্ট জীবনের পরিসীমায় মানুষকে কত বিস্তর জায়গায় পরিভ্রমণ করতে হয়, করতে হয় কত কাজ! সবই জীবনধারণের নিমিত্তে।
মানুষের কাছে তার জীবনের চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই। জীবনকে মানুষ প্রচণ্ড ভালোবাসে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই জীবন যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই আলোবাতাসের পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদনের সুযোগ যে আর পাওয়া যাবে না! সে জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবেরই মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ মানুষের এই যে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা-আকুতি তা চিরায়ত। এই মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে কেউ সহজে চলে যেতে চায় না। কেউ সহজসরল জীবনযাপন করে জীবনকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে চায়। আবার কেউ নানা রকম ছলচাতুরি করে অপরের সর্বনাশ ঘটিয়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করে একটি ‘আনন্দময়’ জীবন গড়তে চায়। কেউ কেউ সেটা করতে গিয়ে অপরের জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। তখন কবি কামিনী রায়ের ‘সুখ’ কবিতার বাণী- ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলী, / এ জীবন মন সকলি দাও, / তার মত সুখ কোথাও কি আছে?/ আপনার কথা ভুলিয়া যাও’ নিরর্থক হয়ে পড়ে। মানুষ প্রকৃতগতভাবেই স্বার্থপর। কথাটি আমার নয়। বলেছেন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল। তাই দেখা যায় কেউ পরের কারণে আপন স্বার্থ বলি দেয় না। বরং নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যকে বলি মানে হত্যা করতেও তার হাত কাঁপে না। তখন তাদের ‘মানুষ’ পরিচয়টি জনসমাজে লোপ পায়, তারা পরিচিত হয় অমানুষ হিসেবে। স্বার্থপরতার এই অশুভ প্রবণতার কমতি নেই, বরং দিন দিন এর বিস্তৃতি ঘটছে। পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে এই দুর্বৃত্তপনার প্রাদুর্ভাব আজ শান্তিপ্রিয় মানুষদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নীল আকাশের নীচে সিনেমার ওই গানটির শেষ স্তবকটি এ রকম- ‘মন্দ ভালো, সাদা কালো, হয়েছে একাকার/ কার পেছনে কে যে ঘোরে চেনা হলো ভার/ চক্ষে লাগে ধাঁধা, সব ঘূর্ণিচাকে বাঁধা/ দেখেশুনে বুঝে নেওয়া এ যে বড় দায়।’ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পরে গানটির কথাগুলো কী অদ্ভুত প্রাসঙ্গিক! আমাদের সমাজে এখন মন্দ আর ভালোর পার্থক্য করা পানির দুই উপাদান অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন গ্যাস পৃথক করার চেয়েও দুরূহ ব্যাপার। ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পানিকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনে পৃথক করা গেলেও সমাজের মন্দ আর ভালো মানুষের পরিচয় নিরূপণ সহজ নয়। মন্দরা এমনভাবে ভালোদের মধ্যে মিশে থাকে যে বোঝার কোনো উপায় থাকে না। বরং কখনো কখনো তারা ভালোদের চেয়েও ভালো সাজার চেষ্টা করে। তাদের অভিনয় এত নিখুঁত যে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। তারা ওই নকল ভালো মানুষদের সম্মান করে, শ্রদ্ধা জানায়। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো, এই মেকি সাদা অর্থাৎ মুখোশধারী ভালোদের পেছনেই মিছিলটা বড় হয়ে থাকে। সারা জীবন চোরাকারবার, মাদক পাচার, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে অর্থবিত্তে ফুলেফেঁপে ওঠা এই মেকিরা দখল করে নেয় সমাজ ও রাষ্ট্রের উচ্চাসন। তারা হয়ে ওঠে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাদের তর্জনীর ইশারায় সবাই ওঠবস করে। তারা যেটা চায়, সেটাই হয়। এভাবেই সমাজ হয়ে উঠেছে দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতকারীদের স্বর্গরাজ্য। অর্থবিত্তের প্রভাব এখন এতটাই প্রবল, দুর্বৃত্ত-দুরাচাররা আজকাল বড় বড় রাজনৈতিক দলের উঁচু পর্যায়ের নেতার আসন অলংকৃত (আসলে কলঙ্কিত) করে বসে আছে। এমনকি আইনপ্রণেতা হিসেবেও তারা মনোনয়ন পায়, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকাও শোভা পায়। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার মোহে জনপ্রতিনিধি মনোনয়নে মন্দ-ভালো, সাদা-কালো বাছবিচারের ধার ধারে না। এ ক্ষেত্রে তারা গণচীনের প্রয়াত চেয়ারম্যান দেং জিয়াও পিংয়ের ‘বিড়াল কালো কি সাদা দেখার দরকার নেই। দেখতে হবে ওটা ইঁদুর ধরতে পারে কি না’ তত্ত্বের অনুসারী হয়ে যায়। এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে বহুকাল ধরে। যার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, জাতীয় সংসদে, এমনকি মন্ত্রিসভায় দুর্নীতিবাজ-দুর্বৃত্তদের আধিক্য দৃশ্যমান। ওদের দাপটে সাদারা সব সময় তটস্থ থাকেন। তারা মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস করেন না। আবার সহ্যও করতে পারেন না। ভিতরে ভিতরে গুমরে মরেন। আমরা কিন্তু অনেকেই এখন ভুলতে বসেছি ১৯৭১ সালে এ দেশে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। একাত্তরে যাদের বয়স ছিল দশ বছরের ওপরে তারা সে যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী, একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাক্ষী। যাঁদের জন্ম একাত্তরের পরে তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। ফলে সে যুদ্ধের কারণ, মহিমা ও গুরুত্ব কতটুকু তা অনুধাবন তাারা না-ও করতে পারেন। এটা তাদের অপরাধ নয়। আমরা পলাশীর যুদ্ধ দেখিনি, ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে এ দেশের কৃষকদের নীল বিদ্রোহ দেখিনি, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ দেখিনি। দেখিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সেই অসীমসাহসী যুদ্ধ; কিন্তু জেনেছি। ইতিহাস পাঠ করে জানতে পেরেছি এই উপমহাদেশে ইংরেজ বেনিয়া, তথা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের কথা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেসব ইতিহাস তো দূরের কথা, বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসই জানে না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকে। আমি ওদের দোষ দিই না। এটা ওদের নয়, আমাদের ব্যর্থতা। সদ্য পেছনে ফেলে আসা পনেরোটি বছর বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চার নামে যে মনগড়া রেসিপির চচ্চড়ি জাতিকে খাওয়ানো হয়েছে, তা কারও মুখে না রুচলেও বলার কোনো উপায় ছিল না। ‘সব গীতেই কানু’ অর্থাৎ সব কীর্তনেই কৃষ্ণের নামের মতো সে ইতিহাসে একজন মাত্র ব্যক্তিকে মহানায়ক হিসেবে উপস্থাপন করার প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল। এই দেশ, এই জাতির স্বাধিকার চেতনার উন্মেষের পেছনে যে শুধু একজন মাত্র ব্যক্তি নন, আরও অনেক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তির ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে, তা শুধু ছাইচাপা দেওয়া হয়নি, রীতিমতো অস্বীকার করার অপপ্রয়াসও প্রকটভাবে লক্ষণীয় ছিল। কথায় আছে, আগুন কখনোই ছাই দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। একটু বাতাসে ছাই উড়ে গিয়ে আগুন বেরিয়ে পড়ে নিমেষেই। এ বছরের ৫ আগস্ট ছিল সেই ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার দিন, যেদিন সেই ছাই উড়ে গেছে। অবারিত হয়েছে আমাদের এই দেশের স্বাধীনতার সত্যিকার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দ্বার।
একাত্তরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা ভেবেছিলাম জীবনটা বোধ হয় হেসে খেলে পার করে দিতে পারব। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কিংবা পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের মতো জাঁতাকলে আমাদের আর পিষ্ট হতে হবে না। শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে; যেখানে হানাহানি থাকবে না, দুর্বৃত্তায়ন থাকবে না, মানুষের জীবন-সম্পদ থাকবে নিরাপদ। কিন্তু আমাদের সে আশা পূরণ হয়নি। ব্রিটিশ-পাকিস্তানিরা ছিল ভিনদেশি লুটেরা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে স্বদেশি লুটেরারা কায়েম করে নতুন বর্গি-রাজত্ব। তারা ঘুষ-দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদ লুণ্ঠন ও বিদেশে পাচার করে আমাদের প্রত্যাশার বাংলাদেশকে আক্ষরিক অর্থেই পরিণত করেছে শূন্য কলসিতে; যা শুধু আওয়াজ করে। কিন্তু কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের জবাব পেতে চোখ রাখতে হবে ইতিহাসের পাতায়, যেখানে লেখা আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী তাবৎ লুণ্ঠনের কাহিনি। বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা নব্য বর্গিদের সে লুণ্ঠনের মওকা করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যাশার বেলুনকে দিয়েছে ফুটো করে। সমাজ পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতকারীদের অভয়ারণ্যে। যে অরণ্যে শান্তিপ্রিয় মানুষেরা হিংস্র চিতা কিংবা নেকড়ের থাবা থেকে বাঁচার জন্য ভীতসন্ত্রস্ত হরিণশাবকের ন্যায় দিগি¦দিক ছুটছে। আসলে এ দুনিয়া বড় বিচিত্র জায়গা। এখানে মানুষের প্রত্যাশার অনেক কিছুই ধরা দেয় না। আর সে জন্য হেসে খেলে জীবন পার করে দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব হয় না। নানা রকম উটকো ঝামেলা এসে সহজসরল জীবনকে জটিলতার মধ্যে ফেলে দেয়, জীবন চলার পথকে করে দেয় এবড়োখেবড়ো। জীবন থেকে হারিয়ে যায় হাসি-আনন্দ। বিষাদের কালো মেঘ এসে ছেয়ে ফেলে জীবনের আকাশ।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক