খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান আমাদের জীবনের তিনটি প্রাথমিক আবশ্যকতা। এর মধ্যে বাড়ি সাধারণত আমরা জীবনে একবারই করে থাকি। আমরা যখন জীবনের সব সঞ্চয় উজাড় করে বসবাসের জন্য বাড়ি নির্মাণ করি, তখন মনেপ্রাণে চাই যে সেটি যেন ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ভেঙে পড়ে যেন জানমালের ক্ষতি না হয়। ঝড় ও বন্যা প্রায়শই ঘটে থাকে বলে, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা সচেতন। এ দুটি বিপদের পূর্বাভাসও কম-বেশি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভূমিকম্প আসে কালেভদ্রে এবং কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই। দুটি বড় মাপের ভূকম্পের মাঝখানে ব্যবধান এতই বেশি থাকে যে আমরা এ ব্যাপারে সচেতনতাই হারিয়ে ফেলি। তাই এ ব্যাপারে আরও বেশি আলোচনা, চর্চা ও সচেতনতা প্রয়োজন। ভূকম্পরোধী বাড়ি বলতে সে রকম বাড়ি বোঝায়, যা দেশের ডিজাইন কোড অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়। এখানে ডিজাইন বলতে কাঠামোগত ডিজাইন বুঝতে হবে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ডিজাইন দুই রকমের হতে পারে, নকশা এবং কাঠামোগত ডিজাইন। নকশায় বাড়ির বহিরঙ্গের সৌন্দর্য বোঝায়। এতে বাড়ির ভূকম্পরোধী গুণ উৎসারিত হয় না। কাঠামোগত ডিজাইন বলতে বোঝায় বাড়ির ব্যবহারগত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুযায়ী ভিতে যথাযথ শক্তি প্রদান। এটি একটি গাণিতিক ক্রিয়া, যা দেশের ডিজাইন কোড মেনে করতে হয়। এ ছাড়া এতে কাঠামো বিশ্লেষণ ও কাঠামোর গতিবিদ্যার প্রয়োগ প্রয়োজন হয়। ভিতের মাটি যদি শক্ত হয় বা বাড়ির ভিত যদি পাথরের ওপর করা যায় তবেই তা হয় আদর্শ। ভিতের মাটির বহন ক্ষমতা ও নেমে যাওয়ার প্রবণতা পরীক্ষাগারে পরীক্ষার ও ক্ষেত্রিক পরীক্ষার দ্বারা বের করে নিতে হবে। ভিতের আপেক্ষিক ধস বাড়িকে বাসের অযোগ্য করে ফেলতে পারে। পৃথক পৃথক খুঁটির ভিত বিশিষ্ট বাড়ি হলে ভিতগুলোকে টাই বিম দিয়ে জুড়ে দিলে আপেক্ষিক ধসের প্রবণতা কমে যায়। ভিতের মাটি নরম হলে মাদুরে ভিত (ম্যাট বা র্যাফট ফাউন্ডেশন) ব্যবহার করা যেতে পারে। বহুতল বাড়ির ভিতের মাটি নরম হলে পাইল ব্যবহার করতে হবে। পাইল ব্যবহারে বাড়ির ভূকম্পরোধী ক্ষমতা বেড়ে যায়। তবে পাইল দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ডিজাইন করে নিতে হবে, আর পাইল নির্মাণ সঠিক হওয়া চাই। বহুতল বাড়ির জন্য মাটির পরীক্ষা যথেষ্ট গভীরতা পর্যন্ত হওয়া প্রয়োজন। ভূমিকম্পে ভিত সম্পর্কীয় সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর পরিস্থিতি হলো পানিমিশ্রিত বেলে মাটি বা পলি মাটি। এ ধরনের মাটিতে ভূকম্পকালীন কম্পনে মাটির তরলীকরণ ঘটে ও বাড়ির কাঠামোর ক্ষতি না ঘটেও পুরো বাড়িটি হেলে পড়ে বাসের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। ১৯৬৪ সালে জাপানের ভূমিকম্পে অনেক বাড়ি এভাবে অনাবাসযোগ্য হয়ে পড়ে। এ ধরনের মাটিতে বাড়ি না বানানোই উচিত। বাড়ির নকশা তৈরির সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে সেটি যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সুবিন্যস্ত হয়। আয়তাকার বা বর্গাকার প্ল্যান বাঞ্ছনীয়। ইংলিশ ‘এল’ বা ‘ইউ’ আকারের প্ল্যান ভূকম্পরোধে সাহায্য করে না। বরং মোচড় খাওয়ার ফলে বাইরের খুঁটিগুলো সহজেই ভেঙে পড়ে। কোনো বাড়ি বিশেষ কারণে ‘এল’ বা ‘ইউ’ আকারের প্ল্যানে তৈরি করা অনিবার্য হলে ‘এল’ বা ‘ইউ’-এর প্রতিটি বাহুকে একক বাড়ি হিসেবে তৈরি করতে হবে আর এদের মধ্যে থাকবে সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী ফাঁক। খুঁটিগুলো সমান দূরত্বে ও সমসত্ব বণ্টনে থাকা বাঞ্ছনীয়। অধিক ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বাড়ির বহিরঙ্গ সৌন্দর্য থেকে বাড়ির ভূকম্প সুরক্ষার দিকে অধিক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দক্ষ বাস্তুকারের দ্বারা স্ট্রাকচার্যাল ডিজাইন করে নেওয়ার পর নকশার পরিবর্তন করা ঠিক নয়। শিয়ার ওয়াল ব্যবহার করলে বাড়ির দুটি উল্লম্ব অভিমুখেই এর পরিমাণ সমান হওয়া চাই। বাড়ির উচ্চতা বরাবর থাকবে সুসামঞ্জস্য ও সুবিন্যস্ত। হঠাৎ কোনো তলায় বাড়ির নকশা পরিবর্তন করা বিধেয় নয়। বিভিন্ন তলার উচ্চতাও সমান হওয়া উচিত। খুঁটি বা শিয়ার ওয়াল ভিত থেকে বাড়ির ছাদ পর্যন্ত যাবে। মাঝে কোথাও এর ছেদ ঘটানো ঠিক নয়। ভারবাহী অঙ্গগুলোর আকারে আকস্মিক পরিবর্তন আনা ঠিক নয়।
বাড়িতে রাখা আসবাব ছাড়াও অকাঠামোগত অংশগুলো ভর বাড়ায়। এ ভর যথেচ্ছভাবে বিন্যস্ত হলে বাড়ির ভূকম্পরোধী গুণ কমে যাবে। ভর বিন্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন অবাঞ্ছনীয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি তলায় একটি ঘরে ভরের ঠাসাঠাসি কাম্য নয়। আবার বাড়ির কোনো একটি তলায় সাঁতারের পুকুর (সুইমিং পুল) তৈরি করলে উচ্চতা বরাবর ঘটে ভরের অসামঞ্জস্য। ভূমিকম্পে এ ধরনের বাড়ি ভেঙে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাড়ির মাধ্যাকর্ষণজনিত ভার বা ওজন বিমের মাধ্যমে প্রথমে খুঁটিতে ও খুঁটির মাধ্যমে ক্রমে ভিতের মাটিতে চলে যায়। এভাবে তৈরি হয় ভারবাহী পথ। এ পথে বিচ্ছিন্নতা থাকলে ঘটে বিশৃঙ্খলা। উদাহরণস্বরূপ, ছাদ থেকে নেমে আসা কোনো খুঁটিকে এক তলায় ভিত পর্যন্ত আসতে না দিলে এ খুঁটিতে নিম্নগামী ভার কাছের অন্যান্য খুঁটি দিয়ে নেমে আসবে আর খুঁটিগুলো হয়ে পড়বে অধিক ভারাক্রান্ত। ফলে ভূকম্পে ভারাক্রান্ত খুঁটিগুলোর ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকবে বেশি। ছাদে পানির চৌবাচ্চা বসিয়ে দেওয়া আজকাল চল হয়েছে। চৌবাচ্চা ছোট হলে তেমন ক্ষতি নেই। কিন্তু বড় মাপের পানির চৌবাচ্চা বা অনেক চৌবাচ্চা ছাদে বসালে তা বিপদ ডেকে আনে। মনে রাখতে হবে, ভূকম্প ভর ভালোবাসে না। এ সমস্যার সমাধান কী? কারণ পানি তো আমাদের চাই। এ ক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে উঁচু করে তৈরি পানির ট্যাংক (ওভার হেড ট্যাংক), যা বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কহীন হবে। অন্যদিকে ছোট চৌবাচ্চা ব্যবহারে সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে। সঠিক পদ্ধতি হলো কম্পিউটার মডেলে পানির চৌবাচ্চা ধরে নিয়ে কাঠামোর বিশ্লেষণ ও ডিজাইন করা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট