সরস্বতী বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে আয়োজন করা হয় সরস্বতী পূজার। আমাদের বাড়িতে প্রতি বছর সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হতো। এখনো হয়। ছোটবেলায় দেখেছি, এদিন হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হতো ছোট ছোট ছেলেমেয়ের। আমারও হাতেখড়ি অনুষ্ঠান হয়েছিল। আবছা মনে পড়ে, কোনো এক সরস্বতী পূজার দিন আমার ছোট মামার কোলে থাকা অবস্থায় পুরোহিত মহাশয় আমার হাতে চক ধরিয়ে দিয়ে কালো স্লেটে অ, আ, ক, খ লিখিয়েছিলেন। পুরোহিতকে সবাই ‘ঠাকুর মশায়’ বলে ডাকতেন। সবাই তাঁকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। তখনকার দিনে শুধু গৃহস্থ বাড়িতে সরস্বতী পূজা হতো। সম্পন্ন বা শিক্ষিত পরিবারকে গৃহস্থ বাড়ি বলা হতো। পারিবারিক পূজার বাইরে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটা করে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হতো। এখন তো, বলতে গেলে, ছোট-বড় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পূজা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু ছাত্র বা ছাত্রীনিবাসেও সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা বিদ্যাদেবীর আরাধনা করে থাকেন। অন্যান্য বছরের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল চত্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো একাডেমিক বিভাগ আলাদাভাবে সরস্বতী পূজার আয়োজন করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু কিছু ক্লাব ও সমিতির উদ্যোগেও পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফি-বছর ঢাকার বেইলি রোডস্থ অফিসার্স ক্লাবে অনেকটা উৎসবের মতো করে বাণী অর্চনা করা হয়ে থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকা পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে এবার তৃতীয়বারের মতো জাঁকজমকের সঙ্গে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হবে। পূজা আয়োজন করেছে ইস্কাটন সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ঢাকা সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকা জজ কোর্টের সনাতন ধর্মাবলম্বী আইনজীবীরা আলাদাভাবে বাগ্দেবীর পূজার আয়োজন করেছেন।
ছোটবেলায় সরস্বতী পূজার দিন সকালে কাঁচা হলুদবাটা গায়ে মেখে স্নান করতে হতো। বড়রা বলতেন, এটা করলে শরীর ও মন নাকি শুদ্ধ হয়। পূজার দিন অনেকে হলুদ পোশাক পরতেন। এখনো পরেন। হলুদ রং শুভ বলে মনে করা হয়। আমি তখন ক্লাস নাইনে। স্পষ্ট মনে পড়ে, সেই প্রথম শাড়ি পরে স্কুলের পূজাতে গিয়েছিলাম। হলুদ রঙের একটা তাঁতের শাড়ি আমার দিদি আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। গরুর দুধ দিয়ে কাচের দোয়াত পূর্ণ করে তার মধ্যে নল-খাগড়ার কলম রেখে দেবীমূর্তির পায়ের কাছে রাখা হতো। মূর্তির সামনে পাঠ্যবই রাখার নিয়ম ছিল। আমার সব বই সেখানে রেখে দিতাম। পরীক্ষায় সব বিষয়ে যেন ভালো নম্বর পাই, এই বিশ্বাসে। পূজার দিন পড়াশোনার বালাই ছিল না। তাই মনটা খুব খুশি খুশি লাগত।
আমার স্কুল ও কলেজজীবন কেটেছে যশোর শহরে। যশোরের মধুসূদন তারাপ্রসন্ন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। ‘এমএসটিপি’ নামেই বেশি পরিচিত। শতাব্দী-প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মধুসূদন নামের একজন জমিদার স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। ইনি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নন। স্কুলের পূজাতে আমরা ছাত্রীরা একেকজন একেক দায়িত্ব পালন করতাম। পূজার প্রসাদ বিতরণের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হতো। এ কাজে খুব আনন্দ পেতাম। অতিথি আপ্যায়ন বরাবরই আমার কাছে খুবই আনন্দের। দুপুরে লুচি, বেগুন ভাজা, বাঁধাকপির তরকারি আর পায়েস পরিবেশন করা হতো। দুপুরের খাবারের জন্য বাড়ি থেকে প্লেট সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হতো। স্কুলের পূজার বাজেট কম। ছাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে খরচ সংকুলান করা হতো। অবশ্য স্কুল কর্তৃপক্ষও কিছুটা সাহায্য করত।
যশোরের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ। আমি এই কলেজে দুই বছর অধ্যয়ন করেছি। কলেজটির বয়স এখন ৮৫ ছুঁই ছুঁই। স্কুলের তুলনায় কলেজের পূজার বাজেট ছিল বড়। তাই সমারোহ ছিল ব্যাপক। ছাত্ররা দল বেঁধে প্রতিমা আনতে যেত ট্রাকে চেপে। সে কী উৎসাহ। তৈরি করা হতো বিশাল তোরণ। প্যান্ডেল সাজানো হতো বর্ণিল সাজে। রঙিন নিমন্ত্রণপত্র বিলি করা হতো। শিক্ষকরা নিমন্ত্রণপত্র পেয়ে যারপরনাই খুশি হতেন। ছাত্রদের হাতে তুলে দিতেন চাঁদা বাবদ কিছু অর্থ। পূজা শেষে খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণ করা হতো। মাইকে সারাক্ষণ বাজত জনপ্রিয় সব বাংলা গান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান, কবিতা, কৌতুক ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল। বিজয়ীদের হাতে কলেজের অধ্যক্ষ তুলে দিতেন আকর্ষণীয় সব পুরস্কার। কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণে মঞ্চস্থ হতো নাটক। পূজা আয়োজনে ছাত্ররাই মুখ্য ভূমিকা পালন করত। ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল গৌণ। ছাত্রীরা এদিন প্রজাপতির মতো সুন্দর করে সেজে এসে দেবীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করত। পূজার পরদিন নিকটবর্তী পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো। সরস্বতী পূজা এলে এসব স্মৃতি মনে দোলা দিয়ে যায়।
লেখক : গল্পকার