শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি এবং দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে মে দিবস বা শ্রমিক দিবস পালিত হলেও এই দিবসের আরও অনেক তাৎপর্য রয়েছে। এর অন্যতম হলো- নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা ও বিভিন্ন বৈষম্য দূর করা। এসব বিষয়ে উন্নত দেশগুলো বেশ সফল হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই কাগজে-কলমেই লিপিবদ্ধ। বিশেষ করে জাহাজশিল্পে, ইমারত নির্মাণে, চামড়া ও পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের এসব স্বার্থ সব সময় উপেক্ষিত হয়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যূনতম সুবিধাটুকুও নিশ্চিত করা হয় না। স্বল্প পরিসরে বহুসংখ্যক শ্রমিকের গাদাগাদি অবস্থান, পুষ্টিকর খাদ্যের ন্যূনতম জোগান নেই, দুর্বল অগ্নিনির্বাপক, মজুরি ও চিকিৎসার বেহাল অবস্থা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে এজন্য এক দোজখখানা। ফলে প্রায়ই ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তারা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এবং শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রতিবেদন মতে, ১৯৯০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে ৩৩টি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১৯৯০ সালে সারাকা গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ৩২ জন নিহত হন। ২০০৬ সালে কেটিএস অগ্নিকাণ্ডে ৬২, ২০১২-এর তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন শ্রমিক মারা যান। ২০২১ সালে হাসেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জন নিহত হন। এসব মিলিয়ে গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ২৯৮ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন ১১৩ জন। এ ছাড়া গত এক বছরে (২০২৪) কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা-নির্যাতনে প্রাণহানি হয়েছে ৮২০ শ্রমিকের।
খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ২৯২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে, তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯৭ জন নির্মাণ খাতে। এ ছাড়া রিকশা শ্রমিক ৪৩, প্রবাসী শ্রমিক ৪১, দিনমজুর ৩২, অক্সিজেন কারখানায় ২৪, নৌপরিবহন খাতে ২৩, বিদ্যুৎ খাতে ২৩, মৎস্য শ্রমিক ১৯, জাহাজ ভাঙা শিল্প ১০, স্টিল মিলে ৯, নৌপরিবহন খাতে ৮, অক্সিজেন ফ্যাক্টরিতে ৭, ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ৬, হোটেল-রেস্তোরাঁ ৫, রাইস মিলে ৫, ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপে ৫, দোকানে ৫ কর্মচারী এবং অন্যান্য খাতে ২৭ জন শ্রমিক নিহত হন। ২০১৩ সালে শুধু রানা প্লাজা ভবন (সাভার) ধসে নিহত হন ১১৩৪ জন। এ ঘটনায় আহত হন আড়াই হাজারেরও বেশি শ্রমিক। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর পুরো বিশ্বের বেশ নজরদারি পরিলক্ষিত হলেও চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্প খাতের ওপর তেমন কোনো নজর নেই। ফলে দুর্ঘটনাপ্রবণ ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজ ভাঙা শিল্পে অঙ্গহানি থেকে ভগ্ন স্বাস্থ্য এমনকি মৃত্যু আড়ালে থেকে যায়। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ১০ বছরে এই শিল্পে দুর্ঘটনায় ১৪৭ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এই এলাকায় ডাচ্-বাংলা শিল্প খাতের প্রভাবে সমুদ্র উপকূলের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ আজ হুমকির পথে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বাংলাদেশে পোশাক খাতে গত ১০ বছরে প্রায় ৫০০টিরও বেশি বড় দুর্ঘটনা রেকর্ড করেছে এবং যেখানে তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত ৬৮% শ্রমিকের নিরাপত্তা নেই বলে উল্লেখ করেছে।
মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব এবং শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বহুতল ভবনে নির্মাণ শ্রমিকরা অরক্ষিত অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি এসব দুর্ঘটনা থেকে পথচারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ফলে নির্মাণ শ্রমিকদের পাশাপাশি আশপাশের মানুষ ও ভবনের নিচের পথচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। কেউ কেউ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছেন। তবে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক মৃত্যুর হার আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কম নয়। আইএলওর ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী- বিশ্বজুড়ে বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা রোগে ২৭ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অর্থাৎ প্রতি ১৫ সেকেন্ডে মারা যান একজন শ্রমিক। বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হন ৩৭ কোটি ৪০ লাখ শ্রমিক। এতে বৈশ্বিক জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪ শতাংশ।
ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ সেক্টরে প্রায় ৫০ লক্ষাধিক শ্রমিক জড়িত। শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনে মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বত্র ‘শিল্প স্বাস্থ্য সেফটি কমিটি’ গঠন করা বাধ্যতামূলক। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এরূপ কমিটি থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে এ কমিটির কোনো কার্যকারিতা নেই। তাই পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত (ওশি) ফাউন্ডেশন শ্রমিকদের অকালমৃত্যু রোধে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো : বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ এর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধানের যথাযথ প্রয়োগ। পোশাক খাতের মতো অন্যান্য সেক্টরেও শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে সেফটি কমিটি গঠন। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে নিহত শ্রমিকের পরিবারকে এককালীন ১০ লাখ টাকা এবং আহত শ্রমিককে ৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার বিষয়টি শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা। আহত শ্রমিকের পুনর্বাসনের বিষয়টি শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, শিল্প খাতের সব সেক্টরে ‘এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম’ (ইআইএস) চালু করা। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্যের জন্য সরকারিভাবে সঠিক ডেটাবেজ তৈরি করা। জাহাজ ভাঙা এলাকায় মালিকপক্ষের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আধুনিকায়ন করা, কর্মস্থলে শ্রমিকদের উপযোগী ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করা। শিল্প মালিক ও ব্যবস্থাপকদের জন্য জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা-২০১৩ সম্পর্কে ওরিয়েন্টেশন দেওয়া। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইউনিট চালু করা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো। সুপারিশগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়