রাজনৈতিক নেতা ও জনগণের সম্পর্ক মাছ ও পানির মতো। মাছ যেমন পানি ছাড়া টিকে থাকতে পারে না, তেমনি রাজনৈতিক নেতা যিনি, জনগণের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক না থাকলে রাজনীতিতে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মাইনাস করার জন্য ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা লাগাতার চেষ্টা চালিয়েছেন। শারীরিক, মানসিক সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে দুজনকে। কোনো অবস্থাতেই তাঁদের জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়ে তাঁরা আত্মসমর্পণ করেননি। কারাবরণ করেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের শাসকদের নানামুখী চাপের মুখেও দেশ ছেড়ে চলে যেতে রাজি হননি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার অন্যায় আবদারেও মাথা নত করেননি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর ওয়ান-ইলেভেনের সময় যে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তার দ্বিতীয় কোনো তুলনা নেই। তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের অপরাধ তিনি স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র। তাঁদের রক্তের উত্তরাধিকার। শহীদ জিয়ার আদর্শকে যাঁরা বুকে ধারণ করেন, তাঁদের আস্থা ও ভালোবাসার লক্ষ্যস্থল। তারেক রহমান এমন এক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসেন, যে সময়ে তরুণদের সিংহভাগ ছিল রাজনীতিবিমুখ। নিজের ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং আরাম-আয়েশে জীবন উপভোগেই তারা ছিল বেশি আগ্রহী। তারেক রহমান সে পথে হাঁটেননি। ভোগবিলাসের জীবন উপভোগের সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও সে লোভ সংবরণ করেছেন সচেতনভাবে। তিনি তাঁর বাবা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং মা তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পথ ধরে রাজনীতিতে নামেন। বাবা শহীদ জিয়ার মতো তৃণমূলের মানুষের কাছে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে যাওয়ার মিশনে নেতৃত্ব দেন। সত্যিকারের যোগ্য লোকদের বেছে নেন একবিংশ শতাব্দীর যাত্রা শুরুর নির্বাচনে।
২০০১ সালে বিএনপির বিশাল জয়ের পেছনে তারেক রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দলকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মতো তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। শহীদ জিয়াকে আক্ষরিক অর্থে অনুসরণের চেষ্টা করেছেন তিনি। তার সুফলও মিলেছে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে। গত দুই যুগে বিএনপির ওপর অনেক ঝড় বয়ে গেলেও এ দল টিকে আছে মাথা উঁচু করে পর্বতসম উচ্চতায়। বিএনপি যে সত্যিকার অর্থে মানুষের হৃদয়রাজ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে তার প্রমাণ মিলেছে চিকিৎসা শেষে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়। দলের পক্ষ থেকে ভিড় না করতে অনুরোধ করা হলেও মানুষের আবেগ থামানো যায়নি। দেশনেত্রীর প্রতি সমর্থকদের শ্রদ্ধা ও আবেগ প্রমাণ করেছে ওয়ান-ইলেভেনের মতো আবার যদি কেউ বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র আঁটে, দেশবাসী তাদেরও ইতিহাসের ডাস্টবিনে বিক্ষিপ্ত করবে।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা সাধারণত তাদের সন্তানদের রাজনীতিতে আনতে চান না। সন্তানদের রাজনীতিতে এনে তাদের ঝুঁঁকির মুখে রাখতে চান না। এ প্রবণতার কারণে রাজনীতিবিদদের সন্তানরা রাজনীতিবিমুখ হন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশ ও দলের প্রয়োজনে নিজে কুলবধূ হয়েও যেমন রাজনীতিতে নেমেছেন, তেমনি পুত্র তারেক রহমানকেও রাজনীতিতে নিয়ে এসেছেন শহীদ জিয়ার আদর্শ বাস্তবায়ন করতে। দেশ ও জনগণের কল্যাণকে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছেন।
তারেক রহমান আত্মকেন্দ্রিকতার বদলে নিজেকে গণমানুষের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন তারেক রহমান। শুরুতেই প্রাধান্য দেন তৃণমূলের রাজনীতিকে। শুরু করেন নিবিড় যোগাযোগ। একবিংশ শতাব্দীর সূচনায় ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি রাজনীতিতে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে পড়েন। দলের নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
প্রতিপক্ষের স্বরূপ উন্মোচনে তিনি যে গঠনমূলক প্রচারণা শুরু করেন তা ফলপ্রসূ হয়। শহীদ জিয়া তৃণমূলের মানুষের হৃদয় জয় করেন যে কৌশলে, তা রপ্ত করতে তারেক রহমান তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপনকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন। তিনি তাতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বিএনপি ২০০১ সালের নির্বাচনে অবিস্মরণীয় জয় অর্জন করেছিল।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পর তারেক রহমানই হলেন একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনে সফল হন। গণমানুষের জন্য তারেক রহমান যে রাজনীতি শুরু করেন তার যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। অশুভশক্তির ষড়যন্ত্র প্রতিটি মুহূর্তে মোকাবিলা করতে হয়েছে। তাঁর রাজনীতির যাত্রাপথ বাধাগ্রস্ত করতে চলেছে নানা ষড়যন্ত্র। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। নোংরা রাজনীতির কুশীলবরা তাঁর চরিত্র হননে হেন চেষ্টা নেই, যা করেনি। এক-এগারোর সময় সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে বিএনপিকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়। তারেক রহমানকে অপপ্রচারের শিকার বানানো হয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ধ্বংসের পরিকল্পিত উদ্দেশ্যে। বিরাজনীতিকরণের লক্ষ্য নিয়ে বিদেশি প্রভুর হুকুমে শহীদ জিয়ার পরিবারের সদস্যদের চরিত্রহননে উঠেপড়ে লাগে বিদেশি শক্তির ভাড়াটে কিছু সংবাদমাধ্যম। এ প্রতিকূল অবস্থায়ও তারেক রহমান তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। আর সে কারণেই তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে নির্দয়ভাবে। শারীরিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা চলেছে সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের সুশীল সরকারের সময়ে। একপর্যায়ে জননন্দিত এ নেতাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। সীমাহীন নির্যাতনের শিকার অসুস্থ তারেক রহমান বিদেশে গিয়েও আদর্শচ্যুত হননি। ওয়ান-ইলেভেনের শাসক কিংবা তাদের দ্বারা ক্ষমতায় আসা গত পৌনে ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের কাছে মাথা নত করেননি। বিদেশে থেকেই তিনি জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। তারুণ্যের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা দেখিয়ে দেশের তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিদেশে থেকেও তিনি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অসীম সাহসে লড়াই করে গেছেন বীরের মতো।
বাংলাদেশ এখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে চলছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। করিডরের নামে বাংলাদেশকে যারা আরেকটি গাজা উপত্যকা বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের কোমরে পুতুল নাচের দড়ি বাধা কি না, জনমনে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষ মানবিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কাউকে মানবিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশের মানুষের আপত্তি নেই। তবে তা হতে হবে দেশবাসীর জ্ঞাতসারে। দেশে যখন কোনো নির্বাচিত সরকার নেই, তখন সরকারের উচিত গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু মানবিক করিডরের ক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা ভিনদেশিদের কাছে ছেড়ে দেওয়ার কথা হচ্ছে। এর পেছনে কী উদ্দেশ্য জড়িত তা মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। সরকারের অতি উৎসাহী মনোভাবকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। সরকার পতিত স্বৈরাচারীর দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে। আমরাও চাই এ দেশে যেন আর কোনো দিন ফ্যাসিবাদী রাজনীতি মাথা চাড়া না দিয়ে ওঠে। যারা করিডরের কথা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বাইরের কারোর কাছে অর্পণের কথা বলছেন, তারা দেশের স্বার্থকে জিম্মি করছেন কি না, সে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে। দেশবাসী এসব ভ্রান্ত তৎপরতা রুখে দিতে সচেতন হয়ে উঠছে। দেশের যুবসমাজও সোচ্চার হয়ে উঠছে যারা দেশকে ভুলপথে নিয়ে যেতে চান, তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। এ দেশের মানুষ সংস্কার চায়, সুশাসন চায়, তবে সবকিছু হতে হবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রেখে। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতাকে নিয়ে হেলাফেলা করা চলবে না। এ দেশকে আরেকটি গাজা বানানো যাবে না। বাংলাদেশের মাটি কিংবা সমুদ্রসীমা ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা কোনো বিশ্বশক্তির ক্ষমতা দেখানোর ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হলে জনগণ মেনে নেবে না। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ থাকতে পারে, তবে সবকিছুর আগে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাবেক জিএস