বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এক অভাবনীয় দ্বিধার মুখোমুখি। একদিকে তাদের উচ্চশিক্ষা, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা। দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে কর্মসংস্থানের অপেক্ষায় থাকেন। চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা হারিয়ে ফেলেন নিজের স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস আর জীবনের লক্ষ্য। এ প্রেক্ষাপটে কিছু তরুণ যখন সাহস নিয়ে শহরের চাকরি ছেড়ে, শহুরে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছেড়ে কিংবা বিদেশে পাড়ি না জমিয়ে ফিরে আসেন মাটির টানে, তখন তা হয়ে ওঠে এক নতুন আশার গল্প।
যশোরের ডহরসিংগা গ্রামের হাফিজুর রহমান সেলিম তেমনই একজন তরুণ। শিকড়ের টানে ফিরে আসা তার গল্পটি শুধু ব্যক্তি সেলিমের নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে দেশের বেকারত্ব সমস্যার একটি কার্যকর সমাধানের প্রতিচ্ছবি।
সেলিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজে পড়াশোনা শেষে মঞ্চের আলো, চরিত্র বিশ্লেষণ আর সংলাপের ভিতর দিয়ে জীবন বোঝার চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের বাস্তবতা ভিন্ন। অন্যদিকে উপযুক্ত চাকরির সন্ধান মিলছিল না সহজে। শেষে বাড়ি ফিরে হতাশাগ্রস্ত সেলিম কর্মসংস্থানের জন্য বেছে নিয়েছেন কৃষিকে। নিজেকে যুক্ত করেন কলেজ শিক্ষক বাবার শুরু করা আমবাগানের কার্যক্রমে।
গত সপ্তাহে যশোর গিয়ে সেলিমের সাক্ষাৎ পাই। সুযোগ হয় তার কৃষি কার্যক্রম ঘুরে দেখার। ডহরসিংগা গ্রামে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিনি। আমবাগানের দিকে যেতে যেতে কথা হয় তার সঙ্গে। সেলিম বলছিলেন, উপযুক্ত চাকরি না পেয়ে যখন হতাশায় নিমজ্জিত তখন আপনার অনুষ্ঠান আমার চোখ খুলে দেয়। ইউটিউবে গিয়ে প্রায় সব প্রোগ্রাম দেখেছি, ‘আপনি বলেছেন কৃষিতে শিক্ষিত তরুণদের যুক্ত হতে। আগামীর বাণিজ্য কৃষিকে ঘিরেই। আপনার কথাগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।’
শুরুটা ২০১২ সালে। আজ তার তত্ত্বাবধানে রয়েছে ৩৫ বিঘা জমির তিনটি আমবাগান। বাগানে গিয়ে মুগ্ধ হলাম। হিমসাগর জাতের আমে ভরে আছে তার বাগান।
প্রায় ৪০ বছর আগে সেলিমের বাবা হারুনর রশীদ যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, তখনই সেখানকার আমের ঘ্রাণে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, আমের এই স্বাদ, এ সম্ভাবনা যদি যশোরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে সেটি হয়ে উঠতে পারে কর্মসংস্থানের একটি বড় ক্ষেত্র। তাই তিনি পড়াশোনা শেষে যশোর ফিরে কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি উদ্যোগ নিয়েছিলেন আমের বাগান গড়ার। সেলিম তার বাবার সেই স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি শুধু আমগাছগুলোর পরিচর্যাই করেন না, নতুন করে রোপণ করেছেন স্বপ্ন, প্রসারিত করেছেন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র এবং হয়ে উঠেছেন আত্মবিশ্বাসী।
বাগানে ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ করলাম সেলিম আমবাগানে সাথি ফসল হিসেবে বস্তায় আদা চাষ করছেন। জানালেন, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে রংপুরে বস্তায় আদা চাষের পর্বটি দেখেই তিনি এ উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রিয় পাঠক, গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি দেখেছি কৃষি এভাবেই ছড়িয়েছে, একজনের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন আরেকজন। দেশে আজ যে কৃষি বৈচিত্র্যের রূপ আমরা দেখছি, ধীরে ধীরে তা তৈরি হয়েছে তরুণদের হাতেই। সেলিমের মতো অনেক তরুণ আজ কৃষিকে বেছে নিচ্ছেন পেশা হিসেবে। এটি শুধু নিজেদের জীবিকার জন্য নয়, বরং গ্রামের আরও বহু মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে। একসময় যে তরুণ চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন আজ তিনি অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন। কৃষির এ নতুন ধারায় রয়েছে পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা আর আধুনিক চর্চা। আমাদের কৃষি আজ আর শুধুই হালচাষ, পানি সেচ, কিংবা মৌসুমি ফসল উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার এক বিরাট ক্ষেত্র। হিমসাগর আম হোক বা ক্যাপসিকাম, মাছ চাষ হোক কিংবা হাইড্রোপনিক সবজি- সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে তরুণদের হাত।
এ প্রবণতা শুধু বাংলাদেশে নয়। শিকড়ের টানে ফিরে আসা তরুণদের সাফল্যের গল্প বিদেশেও আছে। নেদারল্যান্ডসের ইয়নের কথাই ধরুন- একাই সেই তরুণ পরিচালনা করছিলেন বিশাল এক ক্যাপসিকাম খামার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিশিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন সফল এক ব্যবসায়িক মডেল। আমাদের দেশেও যদি এমন উদ্যোক্তা তৈরি হয়, তবে তরুণদের জন্য কৃষি হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের উৎস। ত্রিশালের শিক্ষিত তরুণ সৌরভ আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে দেখিয়েছেন, উচ্চশিক্ষা আর কৃষিকাজ একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। এমন অসংখ্য উদাহরণ প্রতিনিয়তই প্রমাণ করছে, কৃষি খাত কেবল খাদ্যের চাহিদা মেটায় না, এটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা, বাজারব্যবস্থার দুর্বলতা ও মৌসুমি ঝুঁঁকি এখনকার কৃষির প্রধান বাধা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছরই মৌসুমের শুরুতে অসময়ের ঝড়-বৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার কারণে আমের ফলন কমছে। এ ছাড়াও সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থাপনা এবং ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় মাঝেমধ্যেই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবু যারা সচেতন, আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে আগ্রহী এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তারা কৃষিতে সাফল্যের মুখ দেখছেন। সেলিমদের মতো তরুণদের সফলতা প্রমাণ করে, চ্যালেঞ্জ যতই থাকুক, সুযোগ তার চেয়েও বেশি।
আজকের কৃষি সম্প্রসারণ, বৈচিত্র্য আর উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন আমাদের তরুণরা। তারা মাটির মানুষ, কিন্তু তাদের দৃষ্টি প্রযুক্তিমুখী। তারা জানেন কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কেটিং করতে হয়, কীভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য পাঠাতে হয়, কীভাবে স্থানীয় বাজারে চাহিদা বুঝে উৎপাদন পরিকল্পনা করতে হয়। তরুণদের জন্য দরকার শুধু একটু পৃষ্ঠপোষকতা, সঠিক প্রশিক্ষণ আর সহায়তাপূর্ণ নীতিমালা। সরকারের তরফে কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ ফান্ড, সহজ শর্তে কৃষিঋণ, আধুনিক কৃষি প্রশিক্ষণ এবং বাজারসংযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এ তরুণরাই হয়ে উঠবেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি।
হাফিজুর রহমান সেলিমের গল্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কৃষি যদি পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করা যায়, তবে সেটি কেবল বেকারত্বের সমাধান নয়, বরং এক নতুন দিনের সম্ভাবনা তৈরি করবে। নাটকের মঞ্চ ছেড়ে মাঠে নামা সেলিম আজ নিজেই হয়ে উঠেছেন এলাকায় কৃষি পরিবর্তনের বড় এক নায়ক।
তার হাতে গড়া প্রতিটি গাছ বলছে সাহস, পরিশ্রম আর স্বপ্নের গল্প। এ গল্প যেন অনুপ্রেরণা হয় দেশের আরও হাজারো তরুণের জন্য, যারা এখনো অপেক্ষায় আছেন কর্মসংস্থানের। কৃষিই হতে পারে তাদের মুক্তির পথ, যদি মাটি আর মানুষের মাঝে তৈরি হয় সুদৃঢ় সেতুবন্ধন।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব