গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। আছি ডালাসে। মাঝখানে কয়েক দিন ঘুরে এলাম নিউইয়র্ক। নিউইয়র্কের অনেক দর্শনীয় স্থান আগেই দেখেছি। রুজভেল্ট আইল্যান্ড দেখা হয়নি। জায়গাটা নাকি অপূর্ব সুন্দর! হলিউডের অনেক নামকরা ছবির শুটিং এই আইল্যান্ডে হয়েছে। তা ছাড়া জায়গাটি চেরি ফুলের জন্য বিখ্যাত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে আসে চেরি ব্লুসম দেখতে। আমার ভাগ্য খারাপ! চেরি শেষ হয়ে গেছে, দেখা হলো না। তবে দেখলাম আইল্যান্ডটিকে মুগ্ধতা নিয়ে। যেতে যেতে মেয়ে বলছিল, এটি একটি বিশাল পার্ক, ইস্ট রিভারের পাড়ে। আইল্যান্ডটি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের নামে। আমেরিকানরা তাদের এই প্রেসিডেন্টকে খুবই ভালোবাসে তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতার জন্য। আইল্যান্ড ঘুরে দেখতে দেখতে একটা জায়গায় এসে থেমে যাই। যেখানে লেখা আছে, ‘শুধু ভয়কেই ভয় পাওয়া উচিত, যা তোমাকে পঙ্গু করতে পারে’- ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট।
জায়গাটি যেন আমার মতোই হুইলচেয়ারে বসা মানুষের জন্যই করা। এক ব্যক্তি হুইলচেয়ারে বসে আছেন আরেক কিশোরী ক্রাচে ভর দিয়ে তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছে। এই জায়গাটি করা হয়েছে ইনভ্যালিডদের জন্য। অবশ্য আমেরিকানরা কখনই ‘ইনভ্যালিড’ শব্দটি ব্যবহার করে না। এটি দেখে চোখে পানি আসে আমার। আমি ঠিক বুঝতে পারি না কেন রুজভেল্ট আইল্যান্ডে এই স্ট্যাচু! আর এই স্ট্যাচুর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সম্পর্ক কী! রুজভেল্ট সম্পর্কে কিছুটা জানতাম। আরও জানতে আগ্রহী হই। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৮৮২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিউইয়র্কের হাইড পার্কের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাসভূমি ছিল স্প্রিং উড এস্টেটে। রুজভেল্টের বাবার নাম জেমস রুজভেল্ট, মা সারা অ্যান ডিলানো। রুজভেল্ট ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁর প্রপিতামহ ওলন্দাজ বংশোদ্ভূত ছিলেন বলে জানা যায়। রুজভেল্টের পড়াশোনা গর্টন স্কুলে। ছেলেবেলায় তিনি গড়পড়তা ছাত্র ছিলেন। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত পারিবারিকভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর জীবনে গর্টন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এন্ডিকোট প্রিবডি অসামান্য প্রভাব রেখেছিল। সামাজিকভাবে খুবই সক্রিয় ছিলেন তিনি। কলেজের সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। স্নাতক পাস করার পরেরবার এক্সামও পাস করেন। তিনি হার্ভার্ডে পড়ার সময় এলিনূরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং মায়ের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে ১৯০৩ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছেলেবেলায় মারাত্মক অ্যাজমা রোগে ভুগতেন। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতেন না।
১৯৩৩ সালের ৪ মার্চ আমেরিকার ৩২তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁর প্রথম প্রবেশ ঘটে। এর আগে তিনি একজন সিনেটর, নৌবাহিনীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এবং নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ১১ বছর আগে তিনি পোলিওতে আক্রান্ত হন। এতে তাঁর কোমরের নিচের অংশ চিরতরে অসাড় হয়ে যায়। কিন্তু এই দুর্ঘটনা রুজভেল্টকে থামাতে পারেনি। তাঁর মানসিক শক্তি ছিল অদম্য। তিনি যখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল মারাত্মক খারাপ, বেকারত্বের হার ছিল খুবই উচ্চ। পরের বছর মার্চের আগেই দেশটিতে বেকারের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছায়। ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম ১০০ দিনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রুজভেল্ট একের পর এক বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে থাকেন আর কংগ্রেস সেগুলো অনুমোদন দেয়।
রুজভেল্টের ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি অনেকটা ঘুরে দাঁড়ায়। নানা বিভাগে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। তবে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা ক্রমাগত তাঁর বিপক্ষে চলে যেতে থাকেন। ১৯৩৬ সালে বিপুল ভোটে জিতে দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রুজভেল্ট। নিজের দ্বিতীয় মেয়াদেও দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রাণপণ কাজ করেন তিনি।
রুজভেল্ট তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। তখনো মহামন্দার প্রভাব চলছে। অন্যদিকে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। হিটলারের জার্মান বাহিনী ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করে ফেলেছে। দেশে ও দেশের বাইরে তখন অস্থির সময়। যুক্তরাষ্ট্রের রীতি অনুযায়ী তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিয়ম ছিল না। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা রীতি ভেঙে তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দরজা খুলে দিয়েছিল রুজভেল্টের জন্য। আমেরিকার জনগণের বড় অংশ বিশ্বাস করেছিল, অস্থিতিশীল ওই পরিস্থিতির সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রুজভেল্টই পারবেন দেশে ও দেশের বাইরে স্থিতিশীলতা ফেরাতে। যদিও তাঁর ওই সিদ্ধান্তে দলের ভিতরেই অনেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন। রিপাবলিকান পার্টি থেকে তাঁর তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে চরম আপত্তি তোলা হয়েছিল। কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের যুক্তি ছিল, রিপাবলিকান প্রার্থী ওয়েন্ডল উইলকি যোগ্য প্রার্থীই নন। তারা উইলকিকে ‘তৃতীয় শ্রেণি’র প্রার্থী বলে অভিহিত করেছিলেন।
নির্বাচনি প্রচারের শেষ দিকে রুজভেল্ট জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ইউরোপের যুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে তিনি বাইরে রাখবেন। জনগণ তাঁর ওই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে তাঁকে ভোট দিয়েছিল। তৃতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ইতিহাস গড়েন রুজভেল্ট।
রুজভেল্ট তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। তিনি আমেরিকাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরিয়েই রেখেছিলেন। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দেননি। কিন্তু সেই বৈরী সময়ে খুব বেশি দিন তিনি এই প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে আক্রমণ করে জাপান। যুদ্ধে জাপান জার্মানির পক্ষ নিয়েছিল। হঠাৎ আক্রমণের শিকার হয় যুক্তরাষ্ট্র্র। হঠাৎ এই আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র্র। তবে তাদের বিহ্বলতার ঘোর সহজেই কেটে গিয়েছিল। পার্ল হারবার আক্রান্ত হওয়ার পরদিন জাতীয় বেতারে এক ভাষণে রুজভেল্ট ‘দিনটি ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবে’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র সর্বশক্তি নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে অংশ নিতে ১ কোটি ৬০ লাখ আমেরিকান পুরুষকে জড়ো করা হয়। তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৫ হাজার প্রাণ হারান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও নৌবাহিনীর প্রধান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব চমৎকারভাবে পালন করেছেন রুজভেল্ট। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছিলেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র্র প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র এবং যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল। অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানিকে হারাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র্র। সে সময় এক ভাষণে রুজভেল্ট বলেছিলেন, বাক্স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা ও ভয় থেকে মুক্তির জন্য তিনি এই যুদ্ধকে বেছে নিয়েছেন।
১৯৪৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বাদশ বছরে পা রাখেন রুজভেল্ট। সামনে আরও একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রুজভেল্টের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে অক্ষশক্তিকে শুধু হারালেই হবে না; যুদ্ধের পর দীর্ঘমেয়াদি শান্তি বজায় রাখতে হবে। সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য মিত্রদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে। রুজভেল্ট সব পদক্ষেপই নিয়েছিলেন।
দিনরাত পরিশ্রম করছেন রুজভেল্ট। নিজের শরীরের দিকে কোনো খেয়াল নেই। তাঁর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছিল। কিন্তু রুজভেল্ট তখন থামতে ভুলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতার নেশায় পেয়ে বসেছিল তাঁকে। চিকিৎসকরা সতর্কবাণী দিচ্ছিলেন। রুজভেল্ট সেসব সতর্কবাণী উপেক্ষা করে দুর্বল শরীরেই দলীয় মনোনয়ন গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু স্বাস্থ্য নয়, রুজভেল্ট সেবার তাঁর রানিংমেটও বেছে নেন নিজের পছন্দ অনুযায়ী। তিনি নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ওয়ালেসকে বাদ দিয়ে রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন হ্যারি এস ট্রুম্যানকে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত নিয়েও ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়েই নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জনগণের সামনে নিজেকে যথেষ্ট সুস্থ দেখাতেও সক্ষম হন। আগের তিনবারের মতো ভোট না পেলেও ঠিকই জিতে যান রুজভেল্ট। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে ইয়াল্টা সম্মেলনে যোগ দিতে যান রুজভেল্ট। ১৪ হাজার মাইলের জার্নি। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও সোভিয়েত নেতা স্তালিনের সঙ্গে রীতিমতো বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সম্মেলন থেকে ফেরার পরদিন ১ মার্চ কংগ্রেসের সামনে সম্মেলনের প্রতিবেদন দিতে আসেন। সেদিন ১২ বছরের প্রেসিডেন্ট জীবনে প্রথমবারের মতো হুইলচেয়ারে জনসমক্ষে আসেন রুজভেল্ট, হুইলচেয়ারে বসেই ভাষণ দেন।
মার্চের শেষ দিকে অবকাশযাপনে ওয়াশিংটন থেকে জর্জিয়া যান রুজভেল্ট। সেখানেই ১২ এপ্রিল ১৯৪৫ মারা যান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র ৮২ দিন পর তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। এলিনূর ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল মেয়াদে সবচেয়ে দীর্ঘদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান তাঁকে বিশ্বের ফার্স্ট লেডিরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। মানবাধিকার বিষয়ে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন তিনি। তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন এলিনূর। স্বামীর মৃত্যুর পর এলিনূর লেখকরূপে আবির্ভূত হন। তিনি মানবাধিকার বিষয়ে মুখপাত্র হিসেবেও কাজ করেন।
সাধারণত আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়ার রীতি নেই। তবে রুজভেল্ট চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই একই ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টি আইনে পরিণত করা হয়।
ফ্রাঙ্কলিন ডিলেনো রুজভেল্ট আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রিয় ও প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জাতিসংঘ সৃষ্টিতে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি মহামন্দা থেকে জাতিকে বের করতে পেরেছিলেন প্রবল আশাবাদী মনোভাব এবং কঠোর সংকল্পের কারণে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ, উদ্ভাবক এবং রাজনীতিবিদ। র্জিয়ার ওয়ার্ম স্প্রিং এ থাকাকালীন নিজের গাড়ির জন্য এমন একটি যন্ত্রের নকশা করেছিলেন যার মাধ্যমে পায়ের ব্যবহার ছাড়াই গাড়ি চালাতে পারবেন। এ ছাড়াও একটি স্বয়ংক্রিয় সিগারেট বণ্টনকারী যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন, যাতে উপগ্রহ রেডিও সিস্টেম বসানো ছিল। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টেকে এফডিআর নামেই সবাই ডাকত, সাংবাদিকরা তাঁকে ‘স্ফিংকস’ নামটা (The Sphinx) দিয়েছিলেন। তাঁর আট ফুট দীর্ঘ কাগজের ভাস্কর্য তৈরি করা হয় ১৯৩৯ সালে, যা এখনো হোয়াইট হাউসে আছে। তাঁর বইয়ের সংগ্রহ ছিল বিশাল। ১৯৪৫ সালে তাঁর মৃত্যুর সময়ে তাঁর সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার। তিনি কলেজে পড়ার সময় থেকেই বই সংগ্রহ করা শুরু করেছিলেন। প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরিতে ও মিউজিয়াম হাউসে তাঁর বইগুলো আছে। তিনি অসামান্য দ্রুত গতিতে বই পড়তে পারতেন- সকালের নাশতার আগেই একটি বই পড়ে শেষ করতেন, তিনি প্রচুর কফি পান করতেন। তিনি ৩৫টি বই ও ১ লাখ ৫০ হাজারটি চিঠি লিখেছিলেন।
আমেরিকায় দীর্ঘতম সময়ব্যাপী ক্ষমতায় থেকে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন ফ্রাঙ্কলিন ডিলান্ডো রুজভেল্ট। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তিনি পৃথিবীর কেন্দ্রীয় এক চরিত্রে পরিণত হন। রুজভেল্টের মৃত্যুতে আমেরিকার পতাকা অর্ধনমিত রেখে ৩০ দিন জাতীয় শোক পালন করা হয়। তাঁকে স্প্রিং উড এস্টেটের রোজ গার্ডেনে সমাহিত করা হয়। ‘রুজভেল্টের মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে হিটলারের নাৎসি বাহিনী এবং জাপানের পরাশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তাঁর উত্তরসূরি হেরি এস ট্রুম্যান মিত্রশক্তির এ বিজয়কে রুজভেল্টের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করেন। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের ৪৭ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ও রাজনীতির ব্যাপারে এক জরিপে ক্ষমতা, দক্ষতা ও জনপ্রিয়তায় ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের তালিকায় শীর্ষস্থানে দেখানো হয়। যে তিনটি কারণে তাঁকে শীর্ষে রাখা হয়েছে তা হলো- ১. আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি, ২. অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় একজন সফল রাষ্ট্র্রনায়ক এবং ৩. পররাষ্ট্র্রনীতির ক্ষেত্রে একজন সুদক্ষ কূটনীতিক। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে অনেকে আব্রাহাম লিঙ্কন ও জর্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে একই কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ তিন রাজনীতিবিদ বলে থাকেন। রুজভেল্টের অবদানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘আজ থেকে শতসহস্র বছর পরও মানুষ হাঁটু গেড়ে ঈশ্বরকে এই বলে ধন্যবাদ দেবে, হোয়াইট হাউসে একদা ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি টানা চারবার ক্ষমতায় বসেছেন। তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত টানা ১২ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। আর তিনিই সেই প্রেসিডেন্ট যিনি অবশ পা নিয়ে চার মেয়াদে সুনামের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কতটা মানসিক জোর থাকলে এটা করা যায় ভাবলে অবাক হতে হয়! আমেরিকানরা তাঁদের এই প্রাণপ্রিয় প্রেসিডেন্টের প্রতি অসাধারণ ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছে রুজভেল্ট আইল্যান্ডে হুইলচেয়ারে বসা রুজভেল্টের স্ট্যাচু নির্মাণ করে, জুলাই ১৭, ২০২১ তারিখে।
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক