রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা গত কয়েক দিন অবস্থান ও সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করেছেন। এ আন্দোলন মূলত সরকারি চাকরি, পদোন্নতি এবং পেশাগত মর্যাদার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যের প্রতিবাদে চলছে। বুয়েট, চুয়েট, কুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবিকে বাস্তবায়িত করতে তীব্র আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁদের এ কর্মসূচি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও শিক্ষকরাও সমর্থন বা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগে শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় দিন অবস্থান নেন। ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা ১১টার দিকে শাহবাগের মূল সড়কে তাঁরা অবস্থান নেন। এতে শাহবাগ ও আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা ব্যানার-ফেস্টুন হাতে আন্দোলনরত ছিলেন এবং দুপুরে সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে আলটিমেটাম দেন।
এ আন্দোলনের পটভূমি মূলত দুপক্ষের মধ্যে বিদ্যমান বিএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের পেশাগত জটিলতা। বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। অন্যদিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পলিটেকনিক থেকে তিন থেকে চার বছরের কোর্স শেষে ডিপ্লোমা ডিগ্রি পান। চাকরির বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে এ দুই ধরনের শিক্ষার্থীর জন্য পদ সংরক্ষণ ও পদোন্নতির সুযোগ ভিন্ন।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দশম গ্রেডের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে শুধু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররাই আবেদন করতে পারেন। এরপর পদোন্নতির মাধ্যমে নবম গ্রেডে উন্নীত হন তাঁরা এবং এ পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ কোটা সুবিধা পান। অন্যদিকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নবম গ্রেডের চাকরিতে যোগ দিতে পারেন, তবে দশম গ্রেডে তাদের আবেদন করার সুযোগ নেই। এ বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়া বিএসসি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের তিন দফা দাবি হলো-
১. দশম গ্রেডের চাকরিতে স্নাতক প্রকৌশলীদেরও প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
২. নবম গ্রেডে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো পক্ষকে অযৌক্তিক সুবিধা বা কোটা না রাখা।
৩. ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের নামের আগে ‘প্রকৌশলী’ পদবি ব্যবহারসংক্রান্ত নিয়মের পুনর্মূল্যায়ন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, দশম গ্রেডে শুধু ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য পদ সংরক্ষণের কারণে মেধাভিত্তিক নিয়োগের নীতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নবম গ্রেডে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ৩৩ শতাংশ কোটা প্রকৌশল পেশায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। অনেক শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারছেন না, যার ফলে তাঁরা দেশের বাইরে পেশাগত সুযোগ খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, মেধাভিত্তিক উন্মুক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত এবং পদোন্নতির কোটাব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সাত দফা দাবি রয়েছে-
১. উপসহকারী প্রকৌশলী পদ কেবল পলিটেকনিক থেকে উত্তীর্ণদের জন্য সংরক্ষণ করা।
২. সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রকৌশল সংস্থা, বিভাগ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি কোম্পানিতে বিএসসি ও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের অনুপাত ১:৫ নির্ধারণ।
৩. পদোন্নতি কোটা ৩৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা।
৪. প্রশাসনিক পদে প্রশাসন ক্যাডারের মধ্য দিয়ে নিয়োগ নিশ্চিত করা।
৫. প্রকৌশলী পদে অন্য ক্যাডারে নিয়োগ বা পেশা পরিবর্তন বন্ধ করা।
৬. ডিপ্লোমা শিক্ষা মানোন্নয়নের জন্য আধুনিক কারিকুলাম প্রণয়ন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১২ নির্ধারণ, ল্যাব ও ওয়ার্কশপ আধুনিকায়ন।
৭. ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বৃদ্ধি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।
ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁদের জন্য নির্ধারিত দশম গ্রেডের চাকরির সুযোগ বাতিল করলে দেশের প্রায় ২০ লাখ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের ভবিষ্যৎ ঝুঁঁকির মুখে পড়বে। তাঁদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, পদোন্নতির সুযোগ সীমিত এবং নতুন পদ সৃষ্টির অভাব রয়েছে। তাই দশম গ্রেডের পদ সংরক্ষণ তাঁদের জন্য এক প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা। ২৭ আগস্টের ঘটনাবলি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তীব্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। শাহবাগ ও কাকরাইলের সড়কে তাঁরা অবস্থান নেন, যার ফলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ মিছিল ও পদযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়, কিছু ক্ষেত্রে লাঠিচার্জ ও জলকামান ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তবে উভয় পক্ষই মূলত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন এবং দাবির যথাযথ উপস্থাপন চাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সমস্যার মূল উৎস হলো পেশাগত মর্যাদা ও নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাজন এবং পদ সংরক্ষণের অনিয়ম। বহু বছর ধরে এ জটিলতা সমাধান করতে পারা যায়নি। ২০১৩ সালেও একই ধরনের পাল্টাপাল্টি আন্দোলন হয়েছিল। কোনো কিছুতে সমাধান না পাওয়ায় বর্তমান আন্দোলন তীব্র হয়েছে।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। সরকারি ও আধা সরকারি স্থাপনার মানবসম্পদ কাঠামোতে মেধাভিত্তিক উন্মুক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা। দশম গ্রেডের পদ সংরক্ষণে যৌক্তিকতা নিশ্চিত করা হলেও নবম গ্রেডের পদোন্নতি এবং কোটা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, বিএসসি ও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পেশাগত দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করা যেতে পারে।
সরকার ইতোমধ্যেই একটি কমিটি গঠন করেছে, যা বিএসসি ও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষানিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেবে। এক মাসের মধ্যে সুপারিশসহ সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করার কথা রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কমিটি যদি উভয় পক্ষের যৌক্তিক দাবি বিবেচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে সুপারিশ করে, তবে সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো শুধু পেশাগত অধিকার নয়, এটি দেশের প্রকৌশল ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার একটি সুযোগ। শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, বৈষম্যমূলক নিয়োগ ও কোটাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলে দেশের প্রকৌশল সেক্টরে মেধার মূল্যায়ন বৃদ্ধি পাবে এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য উন্মুক্ত পেশাগত সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পেশাগত মর্যাদা এবং নিয়োগে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক ও পেশাজীবীরাও দাবি তুলেছেন। একজন শিক্ষক বলেছেন, ‘বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার যদি যোগ্য হয়, তাহলে কেন তাদের দশম গ্রেডের পরীক্ষা দেওয়া হবে না? মেধার ভিত্তিতেই সুযোগ পাওয়া উচিত।’ অন্য একজন শিক্ষক আরও যোগ করেছেন ‘চাকরির নিয়োগে মেধা বিবেচিত হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি পদ শুধু কোনো এক পক্ষের জন্য সংরক্ষণ করা বৈষম্য।’
ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের দাবিও যুক্তিসংগত। তারা উল্লেখ করেন, দেশে ২০ লাখেরও বেশি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আছেন, আর বিএসসি ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র তিন-চার লাখ। যদি দশম গ্রেডের পদ বাতিল করা হয়, তাহলে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে চরম ঝুঁঁকির মধ্যে পড়বেন। তাঁদের মতে, পদোন্নতির কোটা কমে যাওয়ায় নতুন পদ সৃষ্টি না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। শাহবাগ ও কাকরাইলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সড়কে আন্দোলনকারীদের অবস্থানের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও দেখা দিয়েছে। পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত ছিল, কিছু সময়ে লাঠিচার্জ ব্যবহার করতে হয়। তবে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালানোর চেষ্টা করেছেন।
এ পরিস্থিতিতে সমাধানের মূল পথ হলো উভয় পক্ষের যৌক্তিক দাবি বিবেচনা করে সুনির্দিষ্ট নীতি ও নিয়মাবলি প্রণয়ন। দশম গ্রেডে সংরক্ষিত পদ নিশ্চিত করা হলেও নবম গ্রেডে পদোন্নতির কোটাকে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। মেধাভিত্তিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন করা এবং পদোন্নতি ও নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব করবে। উভয় পক্ষের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা গড়ে তোলাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু শিক্ষার্থী নয়, পেশাজীবী ও শিক্ষক সম্প্রদায়কেও এ সংলাপে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে বর্তমান আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হতে পারে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশে প্রকৌশল পেশায় বিএসসি এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সমস্যা বহু বছরের পুরোনো। উভয় পক্ষের দাবিদাওয়ায় রয়েছে পদ সংরক্ষণ, পদোন্নতি, মেধাভিত্তিক নিয়োগ এবং পেশাগত মর্যাদার সুরক্ষা। সমস্যার স্থায়ী সমাধান আসতে পারে কেবল সরকারি পদক্ষেপ, যৌক্তিক নীতি প্রণয়ন, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে।
বর্তমান আন্দোলন যদি সঠিকভাবে সমাধান হয়, তবে দেশের প্রকৌশল ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও স্বচ্ছ পদোন্নতিব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করবে। তদুপরি এ ধরনের সমাধান শিক্ষার্থীদের হতাশা কমাবে এবং পেশাগত সম্ভাবনা বাড়াবে। এ মুহূর্তে উভয় পক্ষই দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। বিএসসি শিক্ষার্থীরা দশম গ্রেডে প্রবেশাধিকার চাইছেন, ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা দশম গ্রেডের পদ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে চান। বাস্তবিক সমাধান হবে উভয় পক্ষের যৌক্তিক দাবি বিবেচনা করে পদ সংরক্ষণ ও পদোন্নতির সুষমনীতি প্রণয়ন, যাতে দেশীয় প্রকৌশলব্যবস্থায় দক্ষতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক