‘ঢাকাই ছবিতে নায়িকা সংকট আছে বলে আমি মনে করি না। ছবি নির্মাণ উদ্বেগজনক হারে কমেছে। যেসব নায়িকা আছেন তারাই তো কাজ পাচ্ছেন না। তাছাড়া নায়িকা তৈরি না হওয়ার নেপথ্যে দায়ী নির্মাতারা। এখন যেসব নির্মাতা আছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই কাজ আদায় করে নিতে পারছেন না, তাই নায়িকা সংকট আছে এমন কথা আমি মেনে নিতে পারছি না।’ বললেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা।
ঢাকাই ছবিতে দীর্ঘদিন ধরে নায়িকা সংকট চলছে, এমন কথা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভিতরে-বাইরে শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে মতপার্থক্যও আছে। কেউ বলছে গল্প, প্রযোজক আর সিনেমা হল নেই। আবার এ কথার বিপরীত মতও আছে। অনেকের কথায় এসব নেইয়ের মাঝেও সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু সাড়া জাগানো নায়িকা তৈরি হচ্ছে না। আর এর জন্য দায়ী নির্মাতারা। ঢাকাই চলচ্চিত্রের সূচনালগ্ন থেকেই একসঙ্গে একাধিক নায়িকা রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে অভিনয় করে সমানভাবে দর্শক মন জয় করে গেছেন। যেমন ষাটের দশকে শবনম, সুচন্দা, সুজাতা, কবরী, শাবানা, ববিতা। আশির দশকে অঞ্জু ঘোষ, রোজিনা, অরুণা বিশ্বাস, দিতি, চম্পা। নব্বইয়ের দশকে শাবনাজ, শাবনূর, মৌসুমী, পপি, পূর্ণিমা। ২০০৬ সালে এলেন অপু বিশ্বাস, ২০১০ সালে ববি আর ২০১২ সালে মাহিয়া মাহী। চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় ‘একজন নায়িকা বড়জোর ১০ থেকে ১২ বছর এই চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। কারণ এই সময়ের পর তার গ্লামার কমতে থাকে। তাই নায়িকা হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আর থাকে না। এরপর নতুন মুখ প্রয়োজন। আর এই নতুন মুখ আবিষ্কারের দায়িত্ব নির্মাতাদের। যা এখনকার নির্মাতাদের দক্ষতা আর মেধার কারণে হচ্ছে না। ২০০৪ সালে জয়া আহসান চলচ্চিত্রে আসেন এবং সফলতার সঙ্গে অভিনয় করে ২০১১ সালে ‘গেরিলা’ ও ২০১২ সালে ‘চোরাবালি’ চলচ্চিত্রের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। জয়া ২০১৩ সালে কলকাতার ছবিতেও অভিনয় শুরু করেন এবং এখন দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়তায় কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৬ সালে সোহানা সাবা চলচ্চিত্রে আসেন এবং ২০১৬ সালে কলকাতার ছবিতে অভিনয় শুরু করেন। ২০০৮ সালে আসেন বিদ্যা সিনহা মিম, ২০০৯ সালে নুসরাত ইমরোজ তিশা, ২০১৫ সালে নুসরাত ফারিয়া ও পরীমণি, ২০১৬ সালে শবনম বুবলী, সর্বশেষ ২০১৮ সালে পূজা চেরী। এই নায়িকা অবশ্য ২০১২ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। উল্লিখিত নায়িকারা এখনো দর্শকপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছেন। এর মাঝে আরও কিছু নায়িকা এলেও তারা সত্যিকার অর্থে এই অঙ্গনে স্থান করে নিতে পারেননি। চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া বেশ কজন সফল নায়িকা ধারাবাহিকভাবে উপহার দিলেও এখন এই প্রতিষ্ঠানটি সক্রিয় না থাকায় নতুন নায়িকা পাচ্ছে না চলচ্চিত্র জগৎ। নির্মাতারা বলছেন, হাতে গোনা কয়েকজন নায়িকা দিয়ে তো আর ইন্ডাস্ট্রি চলে না। পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রিতে এখন অনেক নায়িকা আছেন। নতুন অনেকেই আসছেন। তবে দক্ষ অভিনেত্রীর অভাব রয়েছে। হাতে গোনা দুই-একজনের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে নির্মাতাদের।’ চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, একের পর এক আসছে নায়িকা। এদের বেশির ভাগই নাচ, গান কিংবা অভিনয়ে দক্ষ নয়। ফলে নবাগতদের নিয়ে খুব একটা সফল হতে পারছেন না নির্মাতারা। ঢালিউডের গোড়াপত্তনেও নায়িকা নিয়ে এই অচলাবস্থা ছিল না।
১৯৩১ সালে নির্মিত প্রথম নির্বাক ছবি ‘দ্য লাস্ট কিস’ কিংবা ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণ করতে গিয়েও নায়িকা সংকটে পড়তে হয়নি নির্মাতাদের। ‘সিনেমায় ভদ্রঘরের মেয়েরা অভিনয় করতে পারবে না’Ñ তখনকার দিনে এমন প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও নায়িকা পেতে গলদঘর্ম হতে হয়নি নির্মাতাদের। লোলিটা, পূর্ণিমা সেন, জহরত আরা, চারুবালা, দেববালা, হরিমতি আর পিয়ারি বেগমকে সহজেই পাওয়া গিয়েছিল এই দুই ছবির নায়িকা হিসেবে। এরপর সুমিতা দেবী, নাসিমা খান, তৃপ্তি মিত্র, সুলতানা জামান, রোজী, শামীম, শবনম, শাবানা, সুচন্দা, সুজাতা, কবরী, ববিতা, চম্পা, দিতি, মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা, পপি, অপু, মাহী, পরী, বুবলীর মতো নায়িকায় সমৃদ্ধ হয় ঢাকার ছবি।
অভিনেত্রী শাবনূর বলছেন, নায়িকা সংকট আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দুই দশকেরও বেশি সময় ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি। আমি মনে করি নায়িকা সংকট নয়, বরং চলচ্চিত্রে অর্থ লগ্নিকারী ও দক্ষ পরিচালকের সংকট রয়েছে।