ইমদাদুল হক খোকন [নৃত্য পরিচালক]
‘বর্তমানে হাতে ছবির কাজ নেই বললেই চলে। এ দুরবস্থা কমপক্ষে এক দশক ধরে চলছে। বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চলে। বাংলাদেশ ডান্স ডিরেক্টর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক খোকনের কথায়, কাজ কমে গেছে, তাই আমরা ভালো নেই। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের ৪০ জন সদস্য এখন কাজের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমি সরকার এবং এফডিসির এমডির কাছে অনুরোধ করব আপনারা যেভাবে পারেন চলচ্চিটাকে বাঁচান। চলচ্চিত্র বাঁচলে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত সবাই বেঁচে যাবেন। আমার উদ্বেগ হচ্ছে, এখন নতুন নির্মাতারা যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন তারা দেশের বাইরে থেকে প্রায় কলাকুশলী এনে কাজ করাচ্ছেন। এতে দেশের কলাকুশলীরা আরও বেকার হয়ে পড়ছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন চাই। কারণ আমাদের দেশে ভালো কলাকুশলীর অভাব নেই। আমি মনে করি এখন আর আগের মতো মানুষ নানা কারণে ফেসবুক আর ইউটিউবে আগ্রহবোধ করে না। তারা বড়পর্দায় মানসম্মত চলচ্চিত্র দেখতে চায়। তাই ষাট থেকে কমপক্ষে আশির দশকের মতো পরিবার নিয়ে দেখার চলচ্চিত্র নির্মাণ হলে সব শ্রেণির দর্শক আবার সিনেমা হলে ফিরবে। এতে চলচ্চিত্রের মানুষের দুঃখ দুর্দশা কেটে যাবে। ইমদাদুল হক খোকন প্রায় দেড় হাজার ছবিতে কাজ করেছেন। ২০১০ সালে ‘মুঘল-ই আজম’ ছবির জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা নৃত্য পরিচালকের সম্মান পান। খোকনের কথায়- ‘একসময় একই দিন ৩-৪টি ছবির নৃত্য পরিচালনা করতে হতো। শিডিউল দিতে পারতাম না। নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে ছবি কমতে শুরু করায় কাজও কমতে থাকে। এ বাস্তবতা মেনে নিলেও দুঃখবোধ হচ্ছে আমিসহ সিনিয়রদের কাজের মূল্যায়ন এখানে হয় না।’
আবু মুসা দেবু [চলচ্চিত্র সম্পাদক, নির্মাতা]
জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, স্টেট ইজ এ বোর্ন কিংবা বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ আলমগীর কবীরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ সিনেমাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চিত্রসম্পাদক আবু মুসা দেবু।
ঝুঁঁকি নিয়ে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি এ সিনেমাগুলোর চিত্রসম্পাদনা করেছিলেন। গুণী এ মানুষটি কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র এডিটরস গিল্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা এ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বসহ অন্য চিত্রসম্পাদকরাও এখন আয় রোজগার নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত। ১৯৬০ সালে ‘সূর্যস্নান’ চলচ্চিত্র সম্পাদনার মাধ্যমে বড়পর্দায় আসেন। চিত্রসম্পাদক হিসেবে সূর্যকন্যা, অপবাদ, যাহা বলিব সত্য বলিব, ধীরে বহে মেঘনা, ধন্যিমেয়ে, চাষীর মেয়ে, কে তুমি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। পাশাপাশি তিনি অভিযোগ, রানী আমার নাম, মায়ের জেহাদ, আদর্শবান সিনেমাগুলো নির্মাণ করেন।
আতিকুর রহমান চুন্নু [ফাইট ডিরেক্টর]
নন্দিত অ্যাকশন পরিচালক আতিকুর রহমান চুন্নুর চলচ্চিত্রে পদার্পণ ১৯৭৭ সালে চিত্রপরিচালক মোতাহার হোসেনের হাত ধরে।
এরপর চিত্রনায়ক জসিমের ফাইটিং দল ‘জেমস গ্রুপ’-এ যুক্ত হন। জসিমের হাত ধরেই চুন্নু বনে যান অ্যাকশন পরিচালক।
এখন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজারের মতো সিনেমায় কাজ করেছেন। কলকাতার ‘শিবা’, ‘অন্যদাতা’, ‘অন্যায়’সহ বেশ কিছু ছবিতেও কাজ করেছেন চুন্নু। তাঁর কথায়- ‘গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অন্যদের মতো আমার হাতেও তেমন কাজ নেই।
ভিন্ন পেশায় গিয়ে কোনোভাবে পরিবার নিয়ে দিনাতিপাত করছি।’
অ্যাকশন পরিচালক হিসেবে চুন্নুর আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজিত সিনেমা ‘অন্যায় অবিচার’ ছবির মধ্য দিয়ে।
কাজকে ভালোবেসে বারবার ঝুঁঁকিপূর্ণ স্টান্ট দিয়েছেন তিনি। ইন্ডাস্ট্রির মানুষের কাছে তিনি ‘চুন্নু মামা’ বলেই পরিচিত। বেশ কিছুদিন রাজউকেও চাকরি করেছেন চুন্নু।
সেলিম মোহাম্মদ [মেকআপ আর্টিস্ট]
চলচ্চিত্রে ১৯৮২ সাল থেকে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন সেলিম মোহাম্মদ। দীর্ঘ কর্মজীবনে নায়করাজ রাজ্জাক, রাজীব, আলমগীর, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাকিব খান, দিতি, ববিতা, শাবানা, রোজিনা, মৌসুমী, শাবনূর, অপু বিশ্বাসসহ সব শিল্পীর মেকআপের কাজ করেছেন। গত কমপক্ষে এক দশক ধরে ছবির কাজ উদ্বেগজনক হারে কমে যাওয়ায় সেলিমের আর্থিক অবস্থাও সংকটে পড়েছে। চলচ্চিত্রের কাজ কমে যাওয়ায় জীবনধারণ করতে নাটকের কাজও করেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘একসময় প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫ দিন শুটিং থাকত।
চলচ্চিত্রের মন্দাবস্থা শুরু হলে জমানো টাকা ভেঙে চলতে হয়েছে। অন্য কোনো ব্যবসাবাণিজ্য নেই যে সেখান থেকে কিছু ইনকাম আসবে। কাজ না থাকার পরও প্রতি মাসে ধারদেনা করে ঘর ভাড়া দিতে হচ্ছে। জমানো টাকাও শেষ। সংসারে টানাটানি চলছে। তাই উপায় না পেয়ে নাটকের কাজে নেমে পড়েছি। মাঝেমধ্যে ছবির কাজ পাই। এখন ভবিষ্যতে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখছি না।’ ফিল্ম মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সেলিম মোহাম্মদ বলেন, চলচ্চিত্রের সব মেকআপ আর্টিস্ট সামর্থ্যবান নন। অনেকেই কাজ না থাকায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। কেউবা আবার ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশায়ও নেমেছেন।