শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেলিম আল দীনের কালিন্দী-পরী ও আলালের গল্প

সেলিম আল দীনের কালিন্দী-পরী ও আলালের গল্প

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

পৌষের শীতমাখা মধ্য দুপুর। বাংলাদেশ প্রতিদিনের দফতরে বসে ‘যৈবতী কন্যার মন’ নির্মাণ ও চলচ্চিত্রের গল্প তুলে ধরলেন নির্মাতা নারগিস আক্তার।  শুধু গল্পই নয়, এ গল্পের প্রধান দুই চরিত্র কালিন্দী আর পরী এবং আলালও সঙ্গে হাজির। মানে এই ভূমিকা যারা বড় পর্দায় রূপায়ণ করেছেন সেই কালিন্দী আর পরী চরিত্রের রূপকার কলকাতার মেয়ে সায়ন্তনী দত্ত আর আলালের চরিত্র যিনি নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন সেই অভিনেতা গাজী আবদুন নূর। তাদের আলাপচারিতা তুলে ধরেছেন-  আলাউদ্দীন মাজিদ

 

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘যৈবতী কন্যার মন’। মঞ্চনাটক থেকে ধারাবাহিক নাটক হয়ে এবার চলচ্চিত্রে রূপ পেয়েছে আলোচিত এই প-ুলিপি। দেশের সিনেমাপ্রেমীদের সামনে বড় ক্যানভাসে ব্যতিক্রমী এ গল্পটি তুলে ধরার দুঃসাহসী প্রয়াস রাখলেন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা নারগিস আক্তার।

নির্মাতা নারগিস আক্তারের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জানলাম সেলিম আল দীনের ‘যৈবতী কন্যার মন’কে ভেঙে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে বড় পর্দার দর্শকদের মতো করে গড়েছেন তিনি। তার কাছে পাল্টা প্রশ্নÑ তাহলে দর্শক কি সেলিম আল দীনের এই গল্প হুবহু পাচ্ছেন না। উত্তরে নির্মাতার দৃঢ় প্রত্যয়ী জবাব, অবশ্যই পাবে। তবে চলচ্চিত্রায়ণ আর মঞ্চনাটক এক নয়। চলচ্চিত্রের ফ্লেভার দর্শকের চোখে-মুখে মেখে দিতে গল্পটির উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সেলুলয়েডের পথেই আমাকে হাঁটতে হয়েছে। দর্শক এই চলচ্চিত্রে সেলিম আল দীন আর নারগিস আক্তারের বুননকে একসঙ্গে খুঁজে পাবেন। তার কাছে আবারও প্রশ্ন, এতে নির্মাতা হিসেবে নিজে কতটা এবং দর্শককে কতটুকু সন্তুষ্ট করতে পারবেন। তার দ্বিধাহীন জবাব, আমি শতভাগ সন্তুষ্ট। কারণ গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ করতে আপাদমস্তক সেলিম আল দীনকেই আঁকড়ে ছিলাম। নির্মাতা জানালেন জানুয়ারিতে ছবিটি সেন্সর বোর্ডে জমা পড়ছে আর মার্চ মাসে এটি বড় পর্দায় উঠবে। প্রথমে দেশে এরপর ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কানাডার দর্শকরা দেখতে পাবে ছবিটি। এই তথ্যের রেশ ধরে নির্মাতাকে কিছুটা কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো করেই প্রশ্ন করলাম ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের সরকারি অনুদান পেয়ে মুক্তিতে এত বিলম্ব কেন? তার আঁটোসাঁটো উত্তর- দেখুন সেলিম আল দীনের গল্প মানে বিশাল ক্যানভাস, শত বছর আগের একটি চিত্রের চলচ্চিত্রায়ণে আমাকে সেই সময়টাতে ফিরে যেতে হয়েছে। এর জন্য কাঠখড় কম পোড়াতে হয়নি কিন্তু। কালিন্দীর চুল আনতে কলকাতা পাড়ি দিতে হয়েছে। শতবর্ষ আগের সেই গান পালা হুবহু তুলে আনতে হয়েছে। এক কথায় কোনো বিষয়ে আপস করিনি। এ নিয়ে ইউনিটের অনেকের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাদের কথায় আমি এত খুঁত খুঁত করছি কেন, কোনোভাবে কাজটি সেরে নিলেই তো হলো। আমার সাফ কথা ‘যৈবতী কন্যার মন’কে গল্পের মতোই দেখতে চাই। এতে কোনো আপস চলবে না। আমার এই দৃঢ়তা দেখে ধৈর্যচুতি ঘটল প্রথম ড্রেস ডিজাইনারের। ছবির কাজ অর্ধেক রেখে পালালেন তিনি। দ্বিতীয় জনেরও একই অবস্থা। গল্পের কালিন্দী ডাগর চোখের কন্যা। সেই ডাগর চোখ খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত ওপার বাংলার সায়ন্তনীর ওপর গিয়ে আমার নজর পড়ল। সে আগে অভিনয় করেনি। তার মধ্যে কালিন্দী আর পরীকে ধারণ করাতে দীর্ঘ সময় ধরে গ্রুমিংয়ের একটি ব্যাপার ছিল। নায়ক গাজী নূর ওপার বাংলায় জনপ্রিয় একটি টিভি সিরিয়ালে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে তাকে সময় বের করে এসে কাজ করতে হয়েছে। আর অনুদানের অর্থ যে এত বড় মাপের ক্যানভাসের ছবির জন্য খুবই অপ্রতুল তা শুরুতে আমার বোধগম্য হয়নি। কাজ করতে গিয়ে বারবার অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছে। আমি কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে পুরোই অটল ছিলাম বলেই দেরিতে হলেও আজ পূর্ণ আস্থা নিয়ে ‘যৈবতী কন্যার মন’কে সার্থকতার সঙ্গে সিনেমা হলে আনতে পারছি।’ এবার কালিন্দী আর পরীর মনের অবস্থা জানতে চাইলাম। ডাগর চোখের হাসি মাখা সেই সায়ন্তনী কথাতেও দৃঢ়তার ছাপ। তার কথায় যদিও আমি আগে অভিনয় করিনি কিন্তু নারগিস ম্যাম গ্রুমিংয়ের মাধ্যমে চরিত্রটি আমার মাঝে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দিলেন যে, ক্যামেরার সামনে আমি সত্যি কালিন্দী আর পরী হয়ে গেছি। পুরো শুটিংয়ের সময় নিজেকে একবারের জন্যও সায়ন্তনী মনে হয়নি। বাকিটা সিনেমা হলে উঠলেই দর্শক রায় দেবেন। এবার আলালের পালা, মানে আলাল রূপী গাজী নূর বললেন আমি কতটা আলাল হতে পেরেছি তা বলবে দর্শক। তবে নির্মাতার একাগ্রতা, একজন প্রখ্যাত গল্পকারের রচনা আর নিজের অভিনয় জীবনের স্বচ্ছতা বজায় রেখে এই ছবির কাজ করতে গিয়ে নিজেকে এক মুহূর্তের জন্যও আলালের বাইরে অন্য কেউ ভাবিনি। তিন রূপকারের কাছে গল্প শুনতে শুনতে একসময় মনে হলো আলাপটা ভারি হয়ে যাচ্ছে। পাঠক হয়তো বোর ফিল করতে পারে। তাই মজার উদ্রেক করা অত্যাবশ্যক। শুরুতে ডাগর চোখের সায়ন্তনীর কাছে ছবির শুটিংয়ের সময়ের কোনো মজার স্মৃতির কথা জানতে চাইলে হেসে উঠে লজ্জায় মুখ লাল করে গাজী নূরকে বললেন, ওই কথাটা বলব, কিন্তু আমার যে লজ্জা পাচ্ছে, গাজী বললেন, ঠিক আছে তাহলে আমিই বলছি,

‘আউটডোরে রোমান্টিক গানের দৃশ্যধারণ চলছে। সায়ন্তনী আমার কাছে এসে ঘনিষ্ঠ হতেই নাকে বিচ্ছিরি গন্ধ ঠেকল, ওই অবস্থাতেই আবিষ্কার করলাম ওর পায়ে মানুষের মল। কি যে সাংঘাতিক অবস্থা। ক্যামেরা অন, শুটিং প্যাকআপ করা যাচ্ছে না। ওই অবস্থায় ওকে জড়িয়ে ধরে গাইতে হচ্ছে...ওফ। গাজীর কথা শেষ না হতেই হাসির রোল আলাপচারিতার ভারি পরিবেশকে হালকা করে দিল। কোনো রকমে হাসি থামিয়ে গাজী আরেকটি মজার ঘটনার অবতারণা করলেন, ‘ছবিতে আমি গায়েন, বাউলের লম্বা চুল নিয়ে গাইছি, গ্রামীণ লোকেশন। শুটিংয়ের মাঝে বিরতি দেওয়া হলে ইউনিটের কয়েকজন বললেন চলুন গ্রামের টং ঘরে গিয়ে চা খেয়ে আসি। গেলাম। বাউল দেখে বেশ লোকজন জড়ো হলো। তারা আমার কাছে গান শুনতে চাইল, আমিও অগত্যা গেয়ে শুনালাম। গাজীর কথার ফাঁকে সায়ন্তনী বলে উঠলেন, ‘জানেন, গাজী ভাই কিন্তু ভালো গাইতে পারেন।’ গাজী হেসে বললেন আরে না, আরেকটি মজার কথা শুনুন, এরপর চায়ের টং ঘরে উপস্থিত একজন বলে উঠলেন ‘ভাই আপনাকে দেখতে তো রাসমণির রাজচন্দের মতো।’ আমিই যে রাসমণির সেই নায়ক ওই পরিচয়টা আর তাকে দিলাম না। মনে মনে হেসে খুন।’ গল্পে আনন্দে দুপুর গড়িয়ে বিকাল, নির্মাতা নারগিস আক্তারের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। কেন? জানতে চাইলে তিনি বললেন, যে ছবিটি নিয়ে এত মজা আর আয়োজন সেই ছবিটি আমার কাছে নিজ সন্তানের মতো। আমি চাই আমার এই সন্তান মানে সেলিম আল দীনের যৈবতী কন্যার মন দেশ বিদেশে সবার মন জয় করুক, ভালোবাসা পাক। এখন ছবির পুরো টিমের মধ্যে এই ভাবনা বৈশাখী ঝড়ের মতো ধুলো উড়াচ্ছে... শুভ কামনা জানিয়ে এক সময় যৈবতী কন্যার মন ছবির আসর ভাঙল। যার যার ব্যস্ততায় ডুবে গেলাম আমরা।

সর্বশেষ খবর