রবিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দর্শক কেন বাণিজ্যিক ছবি দেখছে না

আলাউদ্দীন মাজিদ

দর্শক কেন বাণিজ্যিক ছবি দেখছে না

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। তখন এ দেশে চলছিল উর্দু ছবির একচেটিয় দাপট। মুখ ও মুখোশের পর আরও বেশ কিছু বাংলা ছবি নির্মাণ হলেও সেগুলো চলছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ১৯৬৪ সাল, এই বছর বাংলা ছবির ইতিহাসে ঘটে গেল মহাবিপ্লব। চলচ্চিত্রকার হিসেবে সুভাষ দত্তের তখনো খুব একটা নামডাক হয়নি। তিনি অতি সাধারণ একটি গল্প নিয়েই নিজের ছিপছিপে গড়নে নায়ক হয়ে নির্মাণ করলেন ‘সুতরাং’ ছবিটি। ছবির নায়িকাও নতুন। চট্টগ্রামের মেয়ে মীনা পাল। যাকে সুভাষ দত্ত ফিল্মি নাম দেন ‘কবরী’। বাংলা ছবির দুর্দিনে সুভাষ দত্তের এই সাহসী ভূমিকা বিশাল আকারে সফল হলো। ছবিটি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সম্মাননা পেল। প্রথম কোনো বাংলা ছবি তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসব জয় করে নিল। এর একটিই কারণ ছবিটির গল্প ছিল এ দেশের মাটি ও মানুষের যাপিত জীবনকে ঘিরে। এ ছবিটি দিয়েই দেশীয় চলচ্চিত্রের ট্রেন্ড বদলে গেল। শুরু হলো বাংলা ছবির জয়জয়কার। কিন্তু গত প্রায় কয়েক দশক ধরে বাংলা ছবির অঙ্গনে লেগেছে চরম খরা। বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শক। অতি নিকটের উদাহরণ তুলে ধরলে দেখা যায়- ২০১৯ সালে প্রায় ৫৫টি ছবি মুক্তি পেলেও দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে মাত্র একটি। সেটি হলো শাকিব খান প্রযোজিত ও অভিনীত এবং মালেক আফসারী পরিচালিত ‘পাসওয়ার্ড’। ২০২০ সালের চিত্রও প্রায় একই। এ বছর করোনার কারণে মুক্তি পেয়েছে মাত্র ২৫টির মতো ছবি। আর এর মধ্যে শুধু শাকিব খানের ‘বীর’ ও সিয়াম অভিনীত ‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবি দুুুটি মোটামুটি ব্যবসা করেছে। এ বছরের বাণিজ্যিক ছবির ব্যবসা আরও শোচনীয়। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় ডজন ছবি মুক্তি পেলেও এখন পর্যন্ত একটি বাণিজ্যিক ছবিও দর্শক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু কেন এ অবস্থা? এর জবাবে অনেক বাংলা ছবিপ্রেমী সচেতন দর্শকের মতো একজন ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক সোনিয়া রহমান বলেন, বাণিজ্যিক ছবির এই বেহাল দশার কারণ অনেক। দর্শকের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। তারা এই সময়ের জীবন-যাপনের চিত্র এবং উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর ছবি দেখতে চায়। তাছাড়া বাণিজ্যিক ছবির নির্মাতারা মুখে মুখে দেশপ্রেমের কথা বলেন, বাস্তবে বিদেশি ছবির নকল করেন। এসব ছবিতে সোনার বাংলার সবুজ চিত্রের কোনো ছোঁয়া নেই। অথচ ভিন্ন ধারার ছবি যেমন টেলিভিশন, মনপুরা, আয়নাবাজি, পদ্মাপুরাণ, চন্দ্রাবতী কথা, রেহেনা মারিয়াম নূর ইত্যাদি ছবির দিকে তাকালে আমরা আমাদের পারিপার্শি¦কতার ছায়া খুঁজে পাই। এ ছাড়া ছবির গানও একটি মৌলিক বিষয়। আগে ছবির গানে জীবনের কথা ও হৃদয়ের সুর থাকতো। এখন তা কোথায়?

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক, সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, মানসম্মত ছবি নির্মাণ ও মৌলিক গল্প উদ্বেগজনক হারে কমেছে। তাতে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন। আগে কারা কী গল্প লিখতেন, গীতিকার এবং নির্মাতার মেধা কোন উচ্চতায় ছিল? তাদের মেধাবী ও সময়োপযোগী কর্মযজ্ঞ একটি ছবি দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো সিনেমা হলে আটকে রাখত। এখন এসবের অভাব প্রবলভাবে দৃশ্যমান। কিছু ভিন্ন ধারা ছবি এই অভাব পূরণ করতে পারছে বলেই সেগুলো কিছুটা হলেও দর্শক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে। দেশে-বিদেশে সম্মানিত হচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ছবি দর্শক চাহিদা থেকে দূরে সরে গেছে বলে ব্যর্থ হচ্ছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের  প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম বলেন, সত্যি বলতে দেখার উপযোগী ছবি হচ্ছে না। আগে  বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মাণ হতো। সুস্থ ধারার ছবিও তেমন তৈরি হচ্ছে না। ফলে দর্শকদের ওপর সিনেমা হলে না যাওয়ার দায় চাপানো যাবে না। যানজট ঠেলে সময় আর অর্থ নষ্ট করে কেন সিনেমা হলে ছবি দেখতে যাবে। আগে ছবি দেখার জন্য সিনেমা হল ছিল একমাত্র স্থান। এখন মোবাইল ফোন, নেট, স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ নানা মাধ্যমে ছবি দেখা যায়। এতে বড় পর্দায় ছবি দেখার মজা না পেলেও মিনি ফরম্যাটে নানা দেশের ছবি দেখে তারা পরিতৃপ্ত হচ্ছেন। তাই ছবির গল্প জীবন ঘেঁষা ও আধুনিক নির্মাণেই বাণিজ্যিক ছবির সুদিন ফেরানো সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা হলের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। একই সঙ্গে ভালো ছবি, গল্প আর নির্মাতার অভাব তো রয়েছেই। এখন ছবি দেখার নানা মাধ্যম রয়েছে। তাতে বিশ্বের সব ছবি দেখতে পারছেন মানুষ। তাই অপশন যখন বেশি তখন প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার। শিল্পীদের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পুরনোদের নিয়ে এখনো আমরা আটকে আছি। নতুনদের স্বাগত জানানো দরকার। সিনেমা হলে শুধু এফডিসিভিত্তিক ছবি চালালে হবে না। সব দেশের মানসম্মত ছবি প্রদর্শন করা উচিত। উপমহাদেশীয় ছবিকে গত ৫০ বছর ধরে প্রোটেকশন দিয়ে কি আমাদের শিল্পের কোনো উন্নতি হয়েছে? দর্শক ফেরাতে গল্প, চিত্রনাট্য, শিল্পী, নির্মাতা এবং ক্যামেরায় চোখ রাখার অভাব দূর করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারপারসন হাবিবা রহমান বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ছবি, গল্প ও নির্মাণ মানসম্মত নয়। নেটে ছবি দেখে বাইরের ছবির সঙ্গে এ দেশের ছবির তুলনা করার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শক। তাই তাদের যেমন তেমন নির্মাণ আর গল্পের ছবি দিয়ে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। সিনেমা হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর ও সৃজনশীল মাধ্যম। সিনেমা বড় পর্দায় দেখার বিষয় বলে বড় পর্দায় দেখার সুষ্ঠু অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সিনেপ্লেক্সও বাড়াতে হবে এবং ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মানসম্মত পর্যাপ্ত ছবি নেই। এখন প্রতিযোগিতার যুগ। ছবি দেখার মাধ্যমেরও কোনো অভাব নেই। দর্শক বাইরের যেসব উন্নত মান ও প্রযুক্তির ছবি দেখছে প্রতিযোগিতায় গিয়ে তেম ছবি নির্মাণ করতে হবে। যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ বাড়াতে হবে। কারণ উন্নত বাজেট, গল্প আর নির্মাণের কারণে যৌথ প্রযোজনার ছবি দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখে। তাছাড়া নতুন শিল্পী তৈরি করতে হবে। এক মুখ দর্শক আর কত দেখবে।

সর্বশেষ খবর