‘একবার ভেবে দেখুন, একটা যুদ্ধ হচ্ছে, অস্ত্র চালাচ্ছি আমরা, অথচ কতগুলো প্রাণ হারাচ্ছে যারা এ পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করেনি। কতগুলো গাছ পুড়ে যাচ্ছে, গাছ ধ্বংস নিয়ে কোনো নেতার কোনো মাথাব্যথা নেই। আর যারা দেশপ্রেম দেখাচ্ছেন, তারা এ গাছেদের পুড়ে যাওয়া, গাছের সঙ্গে কত নিরীহ পাখি, পোকামাকড় মারা যাওয়া নিয়ে কিছু বলছেন না। পানি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে কারও হেলদোল নেই। আমি সম্পূর্ণভাবে এরকম ‘দেশপ্রেমের’ বিরুদ্ধে এবং এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে’ - কবির সুমন
দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন আলোচিত ঘটনা। তবে কূটনৈতিক ভাষা ছাড়িয়ে যখন এ উত্তপ্ত ইস্যুতে কথা বলেন বিনোদন জগতের তারকারা, তখন তা আরও বেশি গুরুত্ব পায়। তাদের নানা ধরনের মন্তব্য কখনো জাতীয়তাবাদী আবেগকে উসকে দেয়, আবার কখনো শান্তির বার্তা প্রেরণে সহায়ক হয়। ২২ এপ্রিল পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় পর্যটকসহ ২৬ জন নিহতের ঘটনায় ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুই দেশ একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে, ভঙ্গ করে বিভিন্ন চুক্তি। কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে ৭ মে রাতে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছে ভারত। ‘অপারেশেন সিঁদুর’ নামের সেই মিশনে পাকিস্তানের ৯টি সামরিক ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, এ অভিযানে অন্তত ১৭ জন সন্ত্রাসবাদী নিহত হয়, আহত ৬০-এর বেশি। এরপর দিল্লির আগ্রাসনকে যুদ্ধ ঘোষণার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে হুঁশিয়ার করে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সময়োপযোগী জবাব দিয়ে ধ্বংস করা হয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিনটি রাফায়েল জেট, একটি এসইউ-৩০ এমকেআই, একটি এমআইজি-২৯ ফুলক্রাম, একটি মিগ-২৯ এবং একটি ড্রোন। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই দুই দেশের মধ্যে বিরাজ করছে উত্তেজনা, যা ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের সাধারণ মানুষের মতো প্রভাব ফেলেছে বিনোদন অঙ্গনের তারকাদের মনেও।
এদিকে ভারতীয় শোবিজ তারকারা তাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, বিশেষত যখন পাক-ভারত সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালের উরি হামলা এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর ভারতীয় শোবিজের বড় বড় তারকার মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি বিরূপ মন্তব্য এসেছে। ভারতের ‘অপারেশেন সিঁদুর’ নামের মিশনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চন, সালমান খান, পরেশ রাওয়াল, রিতেশ দেশমুখ, সুনীল শেঠি, চিরঞ্জীবী, অনুপম খেরসহ আরও কিছু তারকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও করেন। এ সময় সুপারস্টার অক্ষয় কুমার তার টুইটারে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমরা যতদিন পাকিস্তানের জঙ্গি কার্যক্রম বন্ধ না করতে পারব, ততদিন শান্তি আসবে না।’ কঙ্গনা রানাউত ও জন আব্রাহাম, যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে একে ‘প্রয়োজনীয়’ হিসেবে অভিহিত করেন। সোনু সুদ লেখেন- ‘জাস্টিস ইজ সার্ভড! জয় হিন্দ।’ অপারেশন সিঁদুর-এর হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে রিতেশ লেখেন- ‘হিন্দ সেনাদের জয়, ভারত মায়ের জয়।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিনেতা অনুপম খের লিখেছেন- ‘ভারত মাতার জয় #অপারেশন সিঁদুর।’ আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল ও সুনীল শেঠি। তবে বলিউডের কিছু তারকা তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান প্রকাশ করেছেন। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, যিনি আগে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শান্তির পক্ষে বার্তা দিয়েছেন। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নিজের সোশ্যাল মিডিয়াতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তির আহ্বান জানান। তিনি লেখেন- ‘আমরা একে অপরকে শ্রদ্ধা না করলে শান্তি সম্ভব নয়।’ তবে কঙ্গনা রানাউত, যিনি রাজনৈতিকভাবে বেশ সক্রিয়, তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ কেবল তখনই প্রয়োজন যখন জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। দেশকে রক্ষা করতে আমাদের যা করতে হয়, তা করা উচিত।’ দক্ষিণী অভিনেতা আল্লু অর্জুন এ অভিযানকে সমর্থন করে লিখেছেন- ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। জয় হিন্দ।’ দক্ষিণী সুপারস্টার রজনীকান্ত বলেছেন, ‘যোদ্ধার লড়াই শুরু হলো। মিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামবে না। মোদিজি গোটা দেশ আপনার সঙ্গে রয়েছে।’ তরুণ নায়িকা রাকুল প্রীত ভারতীয় যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে লিখেছেন- ‘আমাদের বীরদের অতুলনীয় সাহসের জন্য স্যালুট জানাই।’
এই যখন বলিউড তারকাদের ভাষ্য, ঠিক সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি তারকাদের ভাষ্য আবার আলাদা। তারা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই সংযত থেকেছেন। বেশির ভাগ তারকা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। পাকিস্তানি সুপারস্টার আলি জাফর বলেন, ‘যুদ্ধ কখনো কোনো সমস্যার সমাধান নয়। আমরা শিল্পী, আমাদের দায়িত্ব হলো শান্তির বার্তা দেওয়া।’ মাহিরা খান, যিনি বলিউডে শাহরুখ খানের বিপরীতে কাজ করেছেন, তিনিও টুইটে লেখেন- ‘আমরা যখন সন্তান হারাই, তখন দেশের নাম দেখে কষ্ট কম হয় না। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, চাইলেই বন্ধ হতে পারে, যদি আমরা বুঝি।’ তবে পাকিস্তানে ভারতের এ হামলাকে কাপুরুষোচিত বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির জনপ্রিয় অভিনেত্রী হানিয়া আমির। ভারতের এ হামলার প্রতিবাদ করে ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে তিনি লিখেছেন- ‘এটি প্রকৃত অর্থেই কাপুরুষোচিত হামলা! আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন। আমিন।’ অভিনেতা ফাহাদ খান লিখেছেন- ‘যারা এই লজ্জাজনক হামলায় আহত ও নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা। নিহতদের আত্মার জন্য প্রর্থনা। তাদের ভালোবাসার মানুষদের জন্য আজ যে দিন এসেছে, তার জন্য তাদের মনে যেন শক্তি থাকে।’ এরপর তিনি লিখেছেন- ‘আমার আন্তরিক অনুরোধ, উত্তেজনাকর কথাবার্তা দিয়ে আগুন জ্বালানো বন্ধ করুন। নিরীহ মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই? সবার ভালো বোধশক্তির জয় হোক। ইনশা আল্লাহ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ এদিকে দুই বাংলার জনপ্রিয় গায়ক কবীর সুমন এ পাক-ভারত দ্বন্দ্ব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ যুদ্ধের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধ যেই করুক, যারাই করুক, যেভাবেই করুক, আমি যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি। আমি তো লিখেছিলাম আমার গানে গানে এই যুদ্ধ বন্ধের কথা। সেই গান আজ সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একবার ভেবে দেখুন, একটা যুদ্ধ হচ্ছে, অস্ত্র চালাচ্ছি আমরা, অথচ কতগুলো প্রাণ হারাচ্ছে যারা এ পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করেনি। কতগুলো গাছ পুড়ে যাচ্ছে, গাছ ধ্বংস নিয়ে কোনো নেতার কোনো মাথাব্যথা নেই। আর যারা দেশপ্রেম দেখাচ্ছেন, তারা এই গাছেদের পুড়ে যাওয়া, গাছের সঙ্গে কত নিরীহ পাখি, পোকামাকড় মারা যাওয়া নিয়ে কিছু বলছেন না। পানি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে কারও হেলদোল নেই। আমি ৭৭ বছরের বৃদ্ধ। আমি সম্পূর্ণভাবে এরকম ‘দেশপ্রেমের’ বিরুদ্ধে এবং এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে। শেষ কথা এটাই বলি, ‘যে ধর্মের নামে যুদ্ধ হয় আমি সেই ধর্মকে স্বীকার করি না। সেই ধর্মকে আমি ধিক্কার জানাই। যে মতবাদ যুদ্ধ ঘটায় তাকে আমি ধিক্কার জানাই।’
আরেক কিংবদন্তি গায়ক নচিকেতা ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটাই কারণে আমি যুদ্ধ নিয়ে আতঙ্কিত। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ। আপনি-আমি।’ এ গায়ক বরাবর স্পষ্টবাদী। তাঁর দাবি, ‘সারা পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে, যত হিংসা ছড়িয়েছে সব কয়টি যুদ্ধের নেপথ্যে বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। সব যুদ্ধ নাকি ‘স্পন্সর’ করা! আমি প্রমাণ করে দেব।’ গায়কের মতে, এগুলো যুদ্ধের হিড়িক। একটা শ্রেণি এর থেকে লাভবান হচ্ছে। যুদ্ধ মানেই মুনাফার খেলা। কাদের মুনাফা, সেটা বুদ্ধিমানেরা সহজেই বুঝে যান।