রবিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেমন চলছে ঢাকাই ছবি

আলাউদ্দীন মাজিদ

যেমন চলছে ঢাকাই ছবি

কমপক্ষে গত বছর থেকে ঢাকাই চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরেছে এমনটাই শোনা যাচ্ছে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ও দর্শকদের কাছ থেকে। তথ্যটি একেবারেই অমূলক নয়। বিশেষ করে গত বছরের ঈদ আর এ বছরের ঈদে মুক্তি পাওয়া বেশকটি ছবি দেশে তো বটেই, বিদেশের মাটিতেও সাড়া জাগিয়েছে। সর্বশেষ গত ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া ‘সুড়ঙ্গ’, ‘প্রিয়তমা’ ও ‘প্রহেলিকা’ ছবি তিনটি ব্যবসাসফল হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্মাতা ও প্রদর্শকদের মুখে হাসি নেই। অনুসন্ধান করে জানা গেছে এর কারণ দুটি। প্রথমত. শুধু ঈদেই মানসম্মত দর্শক পছন্দের ছবি মুক্তি পায়। ফলে বছরের বাকি সময় ভালো গল্প ও নির্মাণের ছবির অভাবে সিনেমা হল মালিকদের লোকসান গুনতে হয়। দ্বিতীয়ত. চলচ্চিত্র প্রদর্শক ও প্রযোজক উভয়েই বলছে ছবি যতই ভালো চলুক না কেন লাভের মুখ দেখাই যায় না। আর এর জন্য এ দুই পক্ষ একে অপরকে দায়ী করছে। পরস্পরের অভিযোগ কী? সে কথাই বলছেন কয়েকজন প্রদর্শক ও প্রযোজক। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াত বলেন, চলচ্চিত্র ভালো ব্যবসা করা সত্ত্বেও লাভের টাকা প্রযোজকের পকেটে আসে না। কারণ, সিনেমা হল মালিকদের টিকিটের দাম ও টিকিট নিয়ে নানা অসামঞ্জস্য প্রযোজকদের ক্ষতির কারণ। যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। যদি ই-টিকিটিং ও সার্ভার ব্যবস্থা থাকত তাহলেই প্রযোজকরা লাভবান হতো। সিনেপ্লেক্সের টিকিটের প্রবেশ মূল্যের অর্ধেক পায় প্রযোজক। এটি ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা। একটি ছবি খুব সফল ব্যবসা করলেও শুধু প্রদর্শকের কারসাজিতে লোকসান গুনে প্রযোজক। এ দুরবস্থা নিরসনে প্রয়োজন প্রদর্শক-প্রযোজকদের নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হওয়া এবং তাতে টিকিটের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি। যেখানে উল্লেখ থাকতে হবে উভয়ের মধ্যে কে কত করে পাবে। একই সঙ্গে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কারণ ১০০ টিকিট বিক্রি হলে প্রদর্শক দেখায় ৭০টি বিক্রি হয়েছে। প্রযোজক সিনেমা হলে প্রতিনিধি পাঠালে তাতে কোনো লাভ হয় না। কারণ সেই প্রতিনিধিকে সিনেমা হল মালিকরা হাত করে ফেলে এবং প্রযোজককে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়। অন্যদিকে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশিদ বলেন, এ কথা সঠিক নয়, কারণ দু-একটি সিনেমা হল রেসিও ভিন্নভাবে কাটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রদর্শক ও প্রযোজকের মধ্যে ৫০-৫০ অথবা ৬০-৪০ পার্সেন্ট হিসেবে চুক্তি হয়। সিনেমা হল মালিকদের নানা ট্যাক্স ও সার্ভার ভাড়া দিতে হয়। জাজ মাল্টিমিডিয়া আগে প্রতি টিকিট থেকে প্রজেক্টের ভাড়া বাবদ ৩ টাকা করে কেটে নিত। এখন সব সিনেমা হল প্রজেক্টের ভাড়া প্রযোজক থেকে নেয় না। অনেক সিনেমা হল মালিক প্রযোজক থেকে অগ্রিম টাকা নিলেও ছ্িবটি না চললে হল মালিক প্রযোজক থেকে সেই টাকা ফেরত পায় না। এসব সমস্যার জন্য ই-টিকিটিং ব্যবস্থা দরকার। তা ছাড়া উভয় পক্ষে বসেও সমস্যার সমাধান করা যায়। প্রযোজকরা বলে সিনেমা হলের কোনো খরচ নেই। তাহলে সিনেমা হলের মেনটেইন্যান্স খরচ কে দেয়। প্রযোজকদের কাছ থেকে তো এ টাকা নেওয়া হয় না। হল মালিকরা লাভের টাকা থেকেই এ ব্যয় নির্বাহ করে। মোটকথা উভয়ের লাভের জন্য এখন সফটওয়্যার বেইজ সার্ভার ব্যবস্থা চালু করা দরকার। তাহলে কারোর বিরুদ্ধে কারোর আর কোনো অভিযোগ থাকবে না। এদিকে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, সিনেমা ভালো চললেও মুনাফার সব টাকাই প্রদর্শকদের পকেটে চলে যায়। একটি সিনেমা রিলিজ করার সময় প্রযোজক সিনেমাটির সঙ্গে সিনেমা হলে যে প্রতিনিধি প্রেরণ করে তার সঙ্গে সিনেমা হল মালিক যোগসাজশ করে প্রযোজককে টিকিট বিক্রি কম দেখায়। ঢাকার সিনেপ্লেক্সগুলোতে সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি টিকিট বিক্রি হয়। আর সিনেমা হলে এ টিকিটের মূল্য ৫০ থেকে ৬০ টাকা। আমরা প্রযোজকরা টিকিট বিক্রির ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স দিচ্ছি। তারপরও আবার সিনেমা হল মালিক তা কাটবে কেন? প্রদর্শকরা আমাদের সেল আপডেট রিপোর্ট দেয় না। আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেও না। তা ছাড়া সিনেপ্লেক্সগুলো বেআইনিভাবে ৮৫ ভাগ ইংরেজি ছবি চালায়। এতে দেশীয় নির্মাতারা প্রদর্শনের জায়গার অভাবে সিনেমা নির্মাণে উৎসাহ হারায়। এরপর আবার মধ্যস্বত্বভোগী বুকিং এজেন্টদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। তারা প্রদর্শকদের বলে ওই ছবিটি প্রযোজক ১ লাখ টাকার কমে দেবে না। আর প্রযোজককে বলে প্রদর্শক এ ছবিটি ৫০ হাজার টাকার বেশি দেবে না। এই যোগসাজশ করে মাঝখানে তারাই লাভবান হয়। আর ক্ষতির মুখে পড়ে প্রযোজক-প্রদর্শকরা। তাই আমাদের উভয় পক্ষকে একত্রিত হয়ে এ অচলাবস্থা দূর করে দেশীয় ছবির সুদিন ফিরিয়ে আনতে হবে। আরেক সিনিয়র চলচ্চিত্র প্রযোজক কামাল কিবরিয়া লিপু বলেন, যখন অভাব দরজায় কড়া নাড়ে তখন এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করে। মানে ভালো ছবি নেই বিধায় সবার চোখে শুধু ক্ষতিটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেকদিন ধরে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির কার্যকরী কমিটি না থাকায় আমরা আসলে বসে কিছুই ঠিক করতে পারছি না। অনিয়ম চলছেই। প্রযোজক সমিতির কমিটি থাকলে প্রদর্শকদের শর্ত দিয়ে অনিয়ম সংশোধন করা যেত। এখনো উভয়পক্ষ বসে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা যায়। এদিকে স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার মেসবাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, আসলে ভালো ছবি হলে সবাই মুনাফার মুখ দেখে। আমরা সিনেমা হল মালিকরা তাদের টাকা মেরে দিই এ অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। কারণ সরকার নির্ধারিত ট্যাক্স বাদ দিয়ে যা থাকে তা প্রযোজক ও প্রদর্শক ভাগ করে নেয়। এখন আগের মতো দর্শক গ্রহণযোগ্য ছবি পাওয়া যায় না বললেই চলে। তা ছাড়া সিনেমা হলও আশংকাজনক হারে কমেছে।

তাই প্রযোজকরা মনে করছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমি বলব হাওয়া,  পরান, প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গের মতো ছবি নির্মাণ করতে হবে। এসব ছবি ব্যবসাসফল হয় বলে প্রযোজক ও প্রদর্শকরা লাভবান হয়। তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে পরস্পরের আর কোনো অভিযোগ থাকে না এবং থাকবেও না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর