দেশের টিভি ইতিহাসের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ৩৭ বছর ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে এখনো চলছে দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ইত্যাদির এ দুর্বার যাত্রা যেন অপ্রতিরোধ্য। আর এ যাত্রার কান্ডারি একই ব্যক্তি। আর তিনি হচ্ছেন মিডিয়ার সর্বজন গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত। সবার কাছেই প্রিয় মানুষ হানিফ সংকেত। দেশের মিডিয়া জগতে এক অনন্য নিদর্শন তাঁর সৃষ্টি ইত্যাদি। ঐতিহ্য ও শেকড় সন্ধানী ইত্যাদিকেও বলা হয় ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। এই ইন্টারনেট আর ইউটিউবের যুগেও সব শ্রেণি-পেশার এমনকি সব বয়সের দর্শকের কাছে প্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি। আর হানিফ সংকেত হয়ে আছেন মিডিয়া জগতের পথ প্রদর্শক। দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে অনুষ্ঠান করার ধারাবাহিকতায় এবার ইত্যাদির ধারণ হয় বাগেরহাট জেলার মোংলা বন্দরে। প্রতিটি জেলায়ই ইত্যাদির ধারণ স্থানের একটি গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমনি এবারের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লোকেশন দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর-মোংলা বন্দর। ঐতিহ্যবাহী পশুর নদীর তীরে জেটির ওপর নির্মিত জাহাজ আর বন্দরে ব্যবহৃত ক্রেন ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত ইত্যাদির মঞ্চ ছিল বন্দর উপযোগী। মঞ্চের সামনে কয়েক হাজার উচ্ছল ও স্বতঃর্স্ফূত দর্শক দেখলেই মনে হয় বাংলাদেশে এত দর্শক উপস্থিতি শুধু এই একটি অনুষ্ঠানেই দেখা যায়। ইত্যাদির এবারের অনুষ্ঠানটিও ছিল তথ্যসমৃদ্ধ, শিক্ষামূলক ও উচ্চমানের বিনোদনে ঠাঁসা।
এবারের ইত্যাদিতে বাগেরহাটের বিভিন্ন ঐতিহ্য এবং মোংলা বন্দর সম্পর্কে নির্মিত প্রতিবেদনে দর্শকরা এ দুটি স্থান সম্পর্কে জানতে পেয়েছেন। মোংলা থেকে সুন্দরবনের দক্ষিণের শেষ প্রান্ত হিরণ পয়েন্টে ইত্যাদির ক্যামেরার যাত্রা ছিল রোমাঞ্চকর। বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ষাটগম্বুজ মসজিদের ভিতর-বাহির এমনকি ছাদে গিয়েও চিত্রধারণ করা হয়েছে। যারা কখনো ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখেননি তারাও এবারের ইত্যাদি দেখে ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং এর নির্মাতা হযরত খানজাহান সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাবেন। এ ষাটগম্বুজ মসজিদকে কেন্দ্র করেই পুরো বাগেরহাট শহর গড়ে উঠেছে এক প্রাচীন ঐতিহ্যের শহরে। শুধু তাই নয় হানিফ সংকেত প্রতিটি স্থানে গিয়ে বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী প্রত্নসম্পদগুলোকেও তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে খাঞ্জেলি দিঘি, খানজাহানের বসতভিটা, দেশের একমাত্র প্রাচীন সড়ক নিদর্শন, দেশের একমাত্র সংরক্ষিত জলাশয় ঘোড়াদিঘি। সুন্দরবন নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে কিন্তু এত চমৎকারভাবে সহজ-সাবলীল উপস্থাপনায় সঠিক তথ্যভিত্তিক বর্তমান চিত্র খুব একটা দেখা যায় না। পুরাকীর্তির পাশাপাশি এ জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশেষ করে করমজল, হাড়বাড়িয়া, দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট সম্পর্কে প্রতিবেদনগুলো ছিল অত্যন্ত দৃষ্টি সুখকর। করমজলে কুমির প্রজনন কেন্দ্রে মানুষের ডাকে পুকুর থেকে কুমির উঠে আসার চিত্রটি বিস্ময়কর। চারদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝখানে ছোট্ট একটি চরে নেমে উপস্থাপনার অংশটুকু ছিল অসাধারণ। ভালো লেগেছে নারিকেলের ফেলে দেওয়া ছোবড়া এবং আঁশ দিয়ে বাবুই পাখির বাসার মতো পাখিদের বাসা, বিড়ালের বাসাসহ পশুপাখির খেলনা নির্মাণের জন্য ৪০ জন নারীকে নিয়ে রোজী আহমেদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। বাড়ির ছাদ, দেয়াল ও কাঠামোসহ সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি বাড়িও বেশ শৈল্পিক। এসব বাড়ি আমাদের দেশেও বিভিন্ন ইকোপার্কের শোভাবর্ধনে ব্যবহার করা যায়। দর্শকপর্বে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর গান ও খুলনা অঞ্চলের গান নিয়ে কুইজ ছিল স্থানোপযোগী। বাগেরহাটকে নিয়ে পরিচিতিমূলক গান ও বাগেরহাটের দুজন শিল্পীর পরিবেশিত গান ভালো লেগেছে। অ্যারিজোনা রাজ্যে অবস্থিত প্রকৃতির অনন্য বিস্ময় রুক্ষ পাথরে গড়া অতুলনীয় পাথুরে স্থাপত্য, বিশ্বের সর্বোচ্চ গিরিখাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ওপর নির্মিত প্রতিবেদনটি অনবদ্য। প্রায় ২০০ কোটি বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এ গিরিখাত।
ইত্যাদিতে উপস্থাপিত স্যাটায়ারমূলক ছোট ছোট নাট্যাংশগুলো যেমন রসালো তেমনি ধারালো। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীদের সরাসরি রাজনীতি চর্চা ও আত্মসংস্কারে সচেতনতা, সমাজে-রাষ্ট্রে ও নেতৃত্বে ভালো মনের মানুষের প্রয়োজনীয়তা, ঋণখেলাপি ব্যক্তিকে ভিক্ষুকের পরিহাস, নানি-নাতির হেভিওয়েট ও ভিভিআইপি আসামিদের নিয়ে ভুলশুদ্ধ আলাপ, ঘুষ ও চোর গবেষকের তীর্যক সাক্ষাৎকার এবং চাটুকার সাংবাদিকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী ও উপভোগ্য। এছাড়াও ইত্যাদি তুলে ধরে জনকল্যাণে নিয়োজিত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীরব সমাজকর্মীদের। যাদের কখনোই মিডিয়াতে দেখা যায় না। ইত্যাদি তাদের খুঁজে এনে তাদের জীবন সংগ্রাম ও কর্মকান্ড তুলে ধরে। শুধু দেখিয়েই শেষ নয়, তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি পরবর্তীতে ফলোআপও করা হয়। যেমন এবারে দর্শকদের চিঠিতে উল্লেখ করা ভ্রাম্যমাণ মুদির দোকানের অসহায় ইজিবাইক চালক, যিনি নারী হয়েও গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাল-ডাল-তেল-আলু-পিঁয়াজ ইত্যাদি বিক্রি করেন। তার ইচ্ছা পূরণে তাকে ১ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। বনজীবী মোশারফ গাজীর পরিবারকেও দেওয়া হয় ২ লাখ টাকা। মোশারফ গাজী অভাবের তাড়নায় বন সুরক্ষার তিন মাসের নিষিদ্ধ সময়ে বনরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে নদী সাঁতরে সুন্দরবনে যায় মধু সংগ্রহ করতে। ফেরার পথে নদীতে কুমির তাকে টেনে নিয়ে যায় পানির গভীরে। স্বামী হারা ফাতেমা বেগমের গোলপাতার ঘর মেরামত ও একমাত্র ছেলেকে ছোট্ট একটি দোকান করে দেওয়ার জন্য তার পরিবারকে এ অর্থ দেওয়া হয়। ইত্যাদিতে ফাতেমা বেগমের দুঃখের কাহিনি শুনে অনেকেরই চোখ ভিজে যায়। ইত্যাদিতে প্রায়ই মানবিক কাজের পাশাপাশি পরিবেশ উন্নয়ন, সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি মানুষের চারিত্রিক সংস্কারেও ভূমিকা রাখছে। তাই তিন যুগ পুরনো হলেও প্রতিটি ইত্যাদিই যেন নতুন।