বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কেবল একজন কবি বা গীতিকার নন, তিনি এক আন্দোলন, এক ধ্বনি, এক চেতনার নাম। তাঁর রচনায় যেমন বিদ্রোহের বজ্র গর্জন, তেমনি আছে প্রেমের কোমলতা, আবার ভক্তির অপার নিবেদন। তাঁর অসংখ্য গান শুধু শব্দের পরিপাটি বিন্যাস নয়, বরং প্রতিটি গানে লুকিয়ে আছে একটি করে গল্প-সময়ের, সমাজের, অনুভবের। এ লেখায় তুলে ধরা হলো নজরুলের ১০টি বিখ্যাত গানের পেছনের গল্প, যেগুলো তাঁকে প্রেম, দ্রোহ আর বিদ্রোহী কবি থেকে ‘সুরের সাধক’ বানিয়ে তুলেছে।
‘ও মন রমজানের ঐ- প্রথম ইসলামি গান
লোকসংগীত সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে নজরুলের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। তিনি নজরুলের ‘গাঙে জোয়ার এলো ফিরে তুমি এলে কৈ’, ‘বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর’, ‘অনেক ছিল বলার যদি দু’দিন আগে আসতে’ ইত্যাদি গান রেকর্ড করার পর কাউয়ালি ধরনের বাংলায় ইসলামি গান রেকর্ড করার ইচ্ছার কথা জানালেন। তখন নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির কর্মকর্তা ভগবতী বাবুর সঙ্গে আলাপ করার জন্য আব্বাসউদ্দীনকে পরামর্শ দিলেন। আব্বাসউদ্দীন ভগবতী বাবুর সঙ্গে আলাপ করলেন। তিনি এ ধরনের গানের কোনো ভবিষ্যৎ দেখলেন না এবং সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। এর ছয় মাস পর আব্বাসউদ্দীন ভালো একটি সময়ে ভগবতীর কাছে গিয়ে ফের অনুরোধ জানালে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। পাশে অন্য একটি ঘরে তখন নজরুল ইন্দুবালাকে গান শেখাচ্ছিলেন। আব্বাসউদ্দীন নজরুলের কাছে গেলেন এবং জানালেন যে, ভগবতী বাবু রাজি হয়েছেন। এরপর দরজা বন্ধ করে আধা ঘণ্টার ভিতরেই নজরুল লিখে ফেললেন- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ তখনই সুর সংযোগ করে আব্বাসউদ্দীনকে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন ঠিক একই সময়ে আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন- ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।’ গান দুটি লেখার ঠিক চার দিন পর রেকর্ড করা হলো। আব্বাসউদ্দীন গাইলেন। তৈরি হলো প্রথম ইসলামি গানের রেকর্ড। দুই মাস পর ঈদুল ফিতর। আব্বাসউদ্দীন জানতে পারলেন ঈদে গান দুটি প্রকাশিত হবে। যথাসময়ে গান বাজারে এলো। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়। রেকর্ড নম্বর এন-৪১১১। ঈদে ছুটিতে আব্বাসউদ্দীন বাড়ি চলে এলেন। ফিরে এসে ট্রামে-মাঠে-ময়দানে এ গান মানুষের কণ্ঠে শুনতে পেলেন। চারদিকে ভালো খবর পেয়ে তিনি নজরুলের সঙ্গে দেখা করে কদমবুসি করলেন। এরপর তো ইসলামি গানের এ ধারা অব্যাহত থাকল।
‘বিদ্রোহী’- যুদ্ধের রণক্লান্ত গান
১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কেবল একটি কবিতা নয়, বরং একটি জাগরণের নাম। সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর এটি ঝড় তুলেছিল ভারতবর্ষজুড়ে। পরবর্তীতে গান হিসেবেও জনপ্রিয় হয় কবিতাটি, যেখানে কবি তাঁর আত্মাকে ঘোষণা করেন ‘বিশ্ব-বিদ্রোহী বিশ্ব-বিধাত্র’ হিসেবে। এ গান হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের মন্ত্র।
‘বুলবুলি’- প্রেম ও বিষাদের গভীর অনুভূতি
এ গানটি তাঁর দ্বিতীয় ছেলে অরিন্দম খালেদ (বুলবুল)-এর অসুস্থতার সময় রচিত হয় এবং এর মাধ্যমে তিনি প্রেম ও বিষাদের এক গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। এ গানটির রচনার উদ্দেশ্য ছিল ছেলের অসুস্থতার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। ১৯২৬ সালে নজরুলের ছেলে অরিন্দম খালেদ (বুলবুল) গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় নজরুল তাঁর ছেলের চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলেন। ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার ছিল এবং তা সংগ্রহের জন্য তিনি কলকাতায় যাচ্ছিলেন। এ যাত্রাপথে তাঁর মনে গভীর প্রেম ও বিষাদের এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। ট্রেনে যাওয়ার সময় তাঁর মনে যে আবেগ কাজ করছিল, তা থেকেই তিনি এই গজলটি রচনা করেন। গানটিতে বুলবুলি এবং তাঁর প্রিয় ফুলকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি প্রেম, বিষাদ এবং আশা-নিরাশার এক চিরন্তন অনুভূতি তুলে ধরেছেন।
‘কারার ঐ লৌহ কপাট’- ভাঙার গান
মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করায় সংগ্রামীরা একে একে কারারুদ্ধ হতে শুরু করেছেন। স্বদেশি ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ‘বাঙ্গালার কথা’ পত্রিকার সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাশও কারারুদ্ধ হন। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর। তাঁকে জেলে নেওয়া হলে পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয় স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে। তরুণ কবি নজরুলের কাছে সুকুমাররঞ্জন দাশকে পাঠান বাসন্তী দেবী। উদ্দেশ্য ‘বাঙ্গালার কথা’র জন্য একটি কবিতা নেওয়া। সুকুমাররঞ্জন কবিতা চাওয়ার পরপর নজরুল লিখতে শুরু করেন। কবিতাটি ছিল নজরুলের ‘ভাঙার গান’। নজরুলের নিয়ম ছিল, যে কোনো কবিতা ছাপতে দেওয়ার আগে তিনি নিজ হাতে কবিতাটির পরিষ্কার কপি তৈরি করে দিতেন। ‘ভাঙার গান’-এর ব্যাপারেও তিনি তাই করেছিলেন। কবিতাটি ‘বাঙ্গালার কথা’য় ছাপা হয় ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি। ১৯২৪ সালে ‘ভাঙার গান’ একই শিরোনামের (ভাঙার গান) বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার ‘ভাঙার গান’ নিষিদ্ধ করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেছিলেন সিনেমাটির পরিচালক জহির রায়হান। চলচ্চিত্রে জেলখানায় কারাবন্দিদের কণ্ঠে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বারুদের মতো জ্বলে উঠেছিল।
‘শাওন রাতে যদি’- বর্ষার স্নিগ্ধ বিরহ
এ গান নজরুলের বিরহী প্রেমের অন্যতম সেরা নিদর্শন। শাওন রাতের আবহে, বৃষ্টির নরম শব্দে কবির হৃদয়ের ব্যাকুলতা যেন মেঘে মিশে যায়। প্রেমে পাওয়া না-পাওয়ার অনুভব যে কত গভীর তা এই গানে উপলব্ধি করা যায়। কোনো এক স্নিগ্ধ মুহূর্তে তিনি এ গানটি রচনা করেছিলেন।
‘মোর প্রিয়া হবে এসো’- রোমান্টিকতার রূপকথা
এ গান প্রেমের এক অনবদ্য কাব্য। প্রেমিকার প্রতি গভীর আকুলতা, সম্মান ও স্নেহের প্রকাশে নজরুল যেন প্রেমের এক কবি হয়ে উঠেছেন। এখানে প্রেম শুধুই শরীরী নয়, বরং হৃদয়ের, চেতনার, অনুভবের। ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’ গানটির নেপথ্যের গল্প প্রচলিত আছে যে, কাজী নজরুল ইসলাম এ গানটি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়তমা নার্গিসের জন্য, যিনি তাঁর জন্য একটি বিশেষ দিনে অর্থাৎ নার্গিসের বিয়ের দিনে তাঁর দেখা দিতে আসেননি। এ গানটি তাঁর প্রেমের গভীরতা এবং বিরহকে প্রকাশ করে। ১৯২১ সালের জানুয়ারিতে, যখন নজরুল নার্গিসকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। বিবাহের জন্য তিনি নার্গিসের বাড়িতে যান। সেখানে তিনি নার্গিসের মায়ের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, নার্গিস চলে গেছেন। এ ঘটনায় নজরুল গভীর ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন। এ ব্যথিত মনের অনুভূতি থেকেই নজরুল এ গানটি লিখেছিলেন।
‘ধূমকেতু’- আকাশভেদী প্রতিবাদের প্রতীক
নজরুল সম্পাদিত পত্রিকার নাম ‘ধূমকেতু’, যার প্রতিটি সংখ্যা ছিল ব্রিটিশবিরোধী একেকটি ঘোষণাপত্র। এ নামেই তিনি রচনা করেন একটি গান, যা হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুদ্র প্রতিরোধের প্রতীক। ধূমকেতুর মতোই এ গান ঝলসে দেয় ঔপনিবেশিক গোঁড়ামিকে।
‘আলগা করো গো’-ভালোবাসার আকুলতা
‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ গানে কাজী নজরুল ইসলাম একজন প্রেমিকের ব্যাকুল হৃদয়ের কণ্ঠস্বরকে প্রকাশ করেছেন। যেখানে প্রেম, কামনা, সৌন্দর্য আর উন্মাদনা একসঙ্গে মিশে এক অপূর্ব সংগীতরূপ ধারণ করেছে। গানটি রোমান্টিক আবেগের প্রতিফলন, প্রেমিকা-প্রেমিকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, ভালোবাসার আকুলতা, ওই বাঁধন (খোঁপার বাঁধন) যেন চুম্বকবৃত্তের মতো প্রেমিককে আকৃষ্ট করে, কিন্তু সেই বাঁধন খুলে দেওয়ার আকাক্সক্ষাও রয়েছে। গানটিতে ‘দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি’, ‘আন্ধা ইশক মেরা কাস গায়ি’ ইত্যাদির মতো হিন্দি, উর্দু মিশ্র ভাষার শব্দ রয়েছে, যা নজরুলের অনুভবময় রোমান্টিক গজল গানে প্রায় দেখা যায়। গানটির মূল উদ্দেশ্য হলে- প্রেমের উন্মাদনা, আকাক্সক্ষা ও আবেদনময়তার শৈল্পিক প্রকাশ।
‘চল্ চল্ চল্’-স্বাধীনতার পদধ্বনি
এ গানটি বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন রণসংগীত হিসেবে মর্যাদা পায়। সৈনিকজীবনে নজরুল এ গানটি লেখেন, যার প্রত্যেকটি শব্দ যেন প্রেরণার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ গানটি চলার মাঝে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার শপথ শেখায়।
‘নয়নভরা জল গো তোমার’- হৃদয়কে বিদ্ধ করে
এক অসামান্য রোমান্টিক নজরুলগীতি এটি। গানটি প্রেম, আবেগ, আকুলতা ও আত্মত্যাগের এক সংবেদনশীল কবিতা, যা সুরের আবরণে হৃদয়কে বিদ্ধ করে। যদিও গানটির নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায় না, তবু গানের কথামালা ও নজরুলের রচনাশৈলী বিশ্লেষণ করে এর উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক কিছু বোঝা যায়। এ গানের মূল উদ্দেশ্য হলো- প্রেমিকের আত্মসমর্পণ ও প্রেমিকার আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ।