আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বাধীনতার পর পরই নির্মাণ হয়েছে অনেক ছবি। রচনা হয়েছে বহু গান। দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনায় এসব ছবি নির্মাণ ও গান রচনা হয় বলে মনে করেন অনেকে। এ বিষয়ে কথা হয় নির্মাতা, অভিনেতা, গীতিকার ও শিল্পীর সঙ্গে। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল-মুক্তিযুদ্ধের বেশির ভাগ গান রচনা ও ছবি নির্মাণ হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার আগে ও পরে। সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও বর্তমানে সেই মানের দেশের গান রচনা ও মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ হচ্ছে না। এর কারণ কী? এ বিষয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে আপনার পরামর্শ কী? সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও আলী আফতাব
গাজী মাজহারুল আনোয়ার
স্বাধীনতার আগে বা পর পরই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ ও গান রচনা হয়েছে। তখন পথ ও মতের এত বিস্তৃতি এবং পার্থক্য ছিল না, ঐক্য ছিল। যা এখন নেই। যখন থেকে মতাদর্শের ভিন্নতা শুরু হলো তখন থেকেই সব ক্ষেত্রে অবক্ষয় নেমে এলো। পথ ও মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও একটি কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে- স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও ভোগের অধিকার তখন যেমন সবার ছিল এখনো আছে। এই বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে এগোলে আবার সমৃদ্ধ কাজ উপহার দেওয়া সম্ভব। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর বর্তমান প্রজন্ম শোনা কথায় চলছে। তারা সত্যিকারের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছে। ফলে যথাযথ আবিষ্কার তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাসংগীত 'জয় বাংলা, বাংলার জয়' আমারই লেখা। এটি যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের মানুষের মধ্যে শক্তি ও সাহস জোগায়। এই গানটি রচনা করায় ইয়াহিয়া খান অনেকের সঙ্গে আমারও ফাঁসি চায়। এমন জীবনধর্মী রচনা এখন কোথায়? তাছাড়া এই ইতিহাস তো নবপ্রজন্ম জানে না। তারা শুধু শোনার উপলব্ধির মধ্যে আছে। দেশ নিয়ে আমার রচিত আরেকটি শ্রোতাপ্রিয় গান 'একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল' এখন শুধু মতাদর্শের ভিন্নতার কারণেই আর রচনা হচ্ছে না। তাই বলব স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও দেশাত্দবোধকে রক্ষা করতে ঐক্যের বিকল্প নেই। আর এই ঐক্যই পারে কালজয়ী সৃষ্টির দ্বার উন্মোচন করতে। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, স্বপ্নপূরণও করতে হবে আমাদের। নতুন প্রজন্মের কাছে আমার অনুরোধ, দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সত্যিকারের নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই দেশ ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
সোহেল রানা
স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'ওরা ১১ জন'। চলচ্চিত্রটির নামকরণের নেপথ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধের ১১ দফা ও ৬ দফা আন্দোলন। ছবির শুরুতেই তাই যখন 'ওরা ১১ জন' নামটি পর্দায় আসে, তখনই ৬টি কামানের গোলা ছোড়া হয়। খসরু, নান্টু, মুরাদ ছাড়াও বেশ কয়জন মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেন। রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের সহায়তায় ছবিটিতে সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। জয়দেবপুরে শুটিংকালে পালিয়ে থাকা দুজন পাকিস্তানি আর্মিকে ধরে আনে খসরু ও মুরাদ এবং তারা বলেন, 'চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে সরাসরি বেয়নেট চার্জ করা হবে।' এ কথায় অাঁতকে ওঠেন নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম, ক্যামেরাম্যান সামাদ ও অভিনেত্রী শাবানা। ছবিটির অন্য একটি দৃশ্যধারণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল এফডিসির ৪ নম্বর ফ্লোর। শাবানা ও গওহর জামিলের একটি দৃশ্যে খসরু নকল গুলি ব্যবহার না করে সত্যিকারের গুলি ব্যবহার করেছিলেন। সেই গুলির আঘাতের চিহ্ন এখনো ৪ নম্বর ফ্লোরের দেয়ালে রয়ে গেছে। আসলে সে সময় সবেমাত্র একটি স্বাধীন মানচিত্র পেয়েছিলাম। ফলে শিল্পী থেকে কলাকুশলী সবার মাঝেই দেশাত্দবোধটি খুব গাঢ় ছিল। দিন-রাতের খাটুনিকে কেউ-ই পরিশ্রম ভাবিনি। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কাছে কৃতজ্ঞ। তারা অনেক বিষয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। ছবিটি নির্মাণ করা আমার কাছে যুদ্ধজয়ের মতো মনে হয়েছিল। শেষ অবধি জয়ী হয়েছিলাম। আর এভাবেই তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্যতম এই সেরা ছবিটি। কিন্তু পরে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আরেকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ সেই সরকারি সহযোগিতা কিংবা তখনকার শিল্পীদের মতো কাজের প্রতি আন্তরিকতা এখন কোথায়?
মোরশেদুল ইসলাম
আমি বলব মুক্তিযুদ্ধের গান ও চলচ্চিত্র এখন আরও ভালো হচ্ছে। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, স্বাধীনতার আগে বা পরে নির্মিত চলচ্চিত্রের চেয়ে নব্বই দশক বা তার পরে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলো গুণ ও মানে অনেক সমৃদ্ধ। যেমন 'গেরিলা', 'আমার বন্ধু রাশেদ', 'আগুনের পরশমণি', 'আগামী', 'খেলাঘর', '৭১ এর যীশু', 'শ্যামলছায়া', 'মাটির ময়না', 'জয়যাত্রা'সহ আরও অনেক চলচ্চিত্র।
স্বাধীনতার পর পরই নির্মিত ছবিগুলো তাৎক্ষণিক ঘটনাবহুল বলে এসব ছবি দেখতে গিয়ে দর্শক আবেগতাড়িত হয় বলে সহজেই তা সাড়া জাগায়। ওইসব ছবিও ভালো ছিল। যেমন স্বাধীন দেশে নির্মিত প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি 'ওরা ১১ জন'।
১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট মুক্তি পাওয়া চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এই ছবিতে সত্যিকারের অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধের ফুটেজ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া গল্পটিও মর্মস্পর্শী ছিল। ওই সময়ে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অসাধারণ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি হয়েছিল 'ওরা ১১ জন'। তাছাড়া আরও কিছু ছবি দর্শক মন কেড়েছিল। তবে এখন আরও ভালো ছবি হচ্ছে এবং সেগুলো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছে।
নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো কাজ করছে এবং ইতিমধ্যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তারপরও ভালো নির্মাণ করছে। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখাপড়া ও প্রচুর গবেষণা করছে। বিশ্লেষণ করে নিরপেক্ষভাবে নির্মাণ করছে। আমি তাদের এই সফল যাত্রা অব্যাহত রাখতে এবং আরও সমৃদ্ধ কাজ দিয়ে দর্শক প্রত্যাশা পূরণের আহ্বান জানাব।
ফকির আলমগীর
বিশ্বায়নের এই যুগে সবকিছুই পুঁজির দাসত্বে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি থেকে শুরু করে সংস্কৃতিও এর বাইরে নয়। সংগীতের নির্যাসটুকু পুঁজি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যুদ্ধের সময় কিছু ধাপে গান করেছি। তার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালীন গান। যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হয়।
যেমন 'জয় বাংলা বাংলার জয়', 'জনতার সংগ্রাম চলবেই', 'পথে এবার নামো সাথী', 'ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙ্গাতে' প্রভৃতি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কিছু গান করে ছিলাম। যে গান শুনে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে আমরা মনে হচ্ছে ওই আদর্শের জায়গা থেকে সরে এসেছি। এই দেশটাকে আমরা স্বাধীন করেছি একসঙ্গে। কেউ যুদ্ধ করেছে মাঠে, কেউ করেছে কণ্ঠে। যে যেভাবে পারে এই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে।
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর আমার মনে হয় সেই দরদের জায়গাটা আমাদের আর নেই। হয় তো এই কারণে আমরা আজ দেশকে নিয়ে ভালো গান করতে পারছি না। কিন্তু আমি আশাবাদী আমাদের নতুন শিল্পীরা ভালো করবে। বর্তমানে বেশ কিছু ভালো ব্যান্ড দল আছে যাদের আগামীতে ভালো করার অনেক সুযোগ আছে। আমাদের ঐতিহ্যের একটি সোনালি অতীত রয়েছে। সেটা আমাদের সব সময় এগিয়ে নিয়ে যায়। আগে অলিগলিতে হারমোনিয়ামের গলা সাধের আওয়াজ পেতাম। এখন আর সে সুর পাই না।
আমাদের সেই সোনালি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। সংগীতকে পুঁজির দাসত্বে বিকিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এ দেশের ভালো গানগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। এর মাধ্যমেই গুণী শিল্পীরা নতুন প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকবে।'