পারিশ্রমিক পাচ্ছে না বলে এখনো পেশাদারিত্ব তৈরি হয়নি মঞ্চনাটকের অঙ্গনে। পেশাদারিত্ব তৈরি না হওয়াতে চর্চা ও বিকাশে ব্যাঘাত ঘটছে নাটকের এই অঙ্গনে। যার কারণে দিনেদিনে এই অঙ্গন থেকে ঝরে যাচ্ছে শিল্পীরা। মঞ্চের তুলনায় টেলিভিশন অনেক বেশি লাভজনক বলে টেলিভিশনের প্রতিই এখন মঞ্চকর্মীদের বেশি আগ্রহ। মঞ্চে পেশাদারিত্ব ও বেতন চালুর কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই মঞ্চে পেশাদারিত্ব তৈরিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নিজেদের শ্রমে, অর্থে ও মেধায় বেশি দিন টিকে থাকতে গিয়ে অনেক শিল্পী অনিচ্ছা সত্ত্বেও মঞ্চ থেকে দূরে সরে আছেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে 'বাকী ইতিহাস' নাটকের মধ্য দিয়ে নাটক সরণি খ্যাত বেইলি রোডে দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের মঞ্চায়ন শুরু করে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়। পরবর্তীতে চর্চা ও বিকাশে নাটকের এই পরিশীলিত অঙ্গন একটি সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছলেও শুধু পেশাদারিত্বের অভাবে পরিশীলিত এই অঙ্গনটি বর্তমানে অবহেলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মঞ্চের শিল্পীদের নাটকের এ অঙ্গনে ধরে রাখতে হলে এবং মঞ্চের সমৃদ্ধি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব তৈরিতে সরকারকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে মঞ্চের শিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্র্যান্ড চালু থাকলেও আমাদের সমৃদ্ধ এই জগতে এখনো স্যালারি গ্র্যান্ড চালু হয়নি বলে শিল্পীদের মাঝে বিরাজ করছে নানা ধরনের উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা। মঞ্চে পেশাদারিত্ব তৈরিতে ভারতের মতো স্যালারি গ্র্যান্ড চালুর দাবি এদেশের মঞ্চকর্মীদের। স্যালারি গ্র্যান্ড চালুর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের শিল্পী ও নাট্যজনরা দাবি জানিয়ে আসলেও সরকার মঞ্চকর্মীদের দাবি কিছুতেই কর্ণকুহরে নিচ্ছে না বলে মঞ্চনাটক নিয়ে হতাশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন মঞ্চকর্মীরা।
মঞ্চনাটকে পেশাদারিত্ব তৈরি করে মঞ্চের চর্চা ও বিকাশে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের অধিকর্তা নাট্যজন আতাউর রহমান বলেন, 'থিয়েটার দুই ধরনের। একটি হচ্ছে প্রফেশনাল থিয়েটার আর অন্যটি হচ্ছে কমার্শিয়াল থিয়েটার। পেশাজীবীদের থিয়েটার হচ্ছে মানসিকতার উন্নয়নের জন্য যে থিয়েটার। আর কমার্শিয়াল থিয়েটার হচ্ছে শুধু নিছক টাকা কামানোর থিয়েটার। প্রফেশনাল থিয়েটার এবং কমার্শিয়াল থিয়েটারের মধ্যে রুচিগত এবং মেধাগতও অনেক পার্থক্য রয়েছে। সরকার যদি মঞ্চে পেশাদারিত্ব তৈরিতে এগিয়ে না আসে তাহলে মঞ্চের এই অঙ্গনকে রক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে'।
পেশাদারিত্ব তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি করপোরেট কোম্পানিগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন আতাউর রহমান। তিনি আরও বলেন, 'নাটকের মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে সরকার অনুদান প্রথা চালু করলেও এই অনুদান প্রথা দিয়ে মঞ্চনাটকের এই অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করা যাবে না। অনুদান প্রথা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্যালারি গ্র্যান্ড চালু করার বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে'।
পেশাদারিত্ব তৈরির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, 'মঞ্চের পেশাদারিত্ব তৈরিতে সরকার ও করপোরেট কোম্পানিগুলোকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো মঞ্চনাটককে টিকিয়ে রাখাটাই কষ্টকর হবে। স্যালারি গ্র্যান্ড চালুর পাশাপাশি অনুদানসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে নাটকের ঐতিহ্যবাহী এই অঙ্গনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এখনই সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নিজের খেয়ে বিনা পারিশ্রমিকে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না বলেই মঞ্চের শিল্পীরা টেলিভিশনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মোট কথা পেশাদারিত্ব তৈরি না হলে মঞ্চনাটকের ক্ষেত্র কখনোই সমৃদ্ধ হবে না।'
পেশাদারিত্ব তৈরি করে মঞ্চনাটকের ঐতিহ্যকে অটুট রাখতে হলে সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই। আর এ বিষয়টি প্রয়োগ হলে মঞ্চের প্রতি আবার আগ্রহ বাড়বে সবার। তৈরি হবে নতুন নতুন মঞ্চকর্মী। পাশাপাশি যারা টিভি নাটক নিয়ে ব্যস্ত, তারাও আবার মঞ্চের দিকে ঝুঁকবেন বলে প্রত্যাশা।