একটি দেশ তার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে তোলে ধরে নিজেকে। তেমনি আমাদের দেশেও রয়েছে নানা ধরনের সংস্কৃতি। একটি সংস্কৃতির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তার দেশের গান। একেক ঘরানার গান গেয়ে শিল্পীরা নিজে দেশের কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারেন খুব সহজেই। কোনো একটি দেশ, জাতি বা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সংগীতকে ফোক সংগীত বলা হয়ে থাকে। অনেকে ফোক গানকে ওয়ার্ল্ড মিউজিকও বলে থাকেন।
সাধারণত কোনো একটি অঞ্চলের নিজস্ব ঢঙে সুর ও সংগীত ব্যবহার করে। সে অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে এবং গানের কথায় সে অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে ফোক গানের সৃষ্টি করা হয়। বহুকাল ধরে এসব ফোক গান মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে বলে এসব গানের কথা, সুর ও সংগীতে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। ফোক সংগীতের একটি বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা সংস্কৃতির ফোক গান নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে এবং অঞ্চলভেদে এর বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। বংশপরম্পরায় এবং যুগ যুগ ধরে এসব গান চলতে থাকে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ফোক সংগীতে বড় কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। আমাদের দেশে জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, গম্ভীরাসহ আরও নানা ধরনের ফোক গানের সম্ভার রয়েছে। লালন সাঁই, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, আব্বাসউদ্দিন, আবদুল আলীম, মমতাজ এরা নানা সময়ে নানা ধরনের ফোক সংগীত সৃষ্টি করে এবং গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন।
বর্তমান সময়ে লালন ব্যান্ড, জলের গান, অর্ণবসহ অনেক শিল্পী রয়েছেন যারা ফোক ফিউশন গান করে থাকেন। এ ছাড়া আমেরিকায় বব ডিলান, বব গিবসন, জন ডেনভারের মতো শিল্পীরা ফোক গানের জন্য বিখ্যাত। এত সব আয়োজনের মধ্যেও কোথায় যেন অসঙ্গতি রয়ে গেছে। কেননা অনেকেই মনে করেন ফোক গান আগের মতো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। যেসব গান হচ্ছে তা মাটি ও মানুষের কাছে যাচ্ছে না।
তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন বাউলশিল্পী কালা মিয়া। তিনি বলেন, ‘বাউল গান আমার রক্তে মিশে আছে। তারপরও কিন্তু আমি সব ধরনের আঞ্চলিক গান গাওয়ার চেষ্টা করি। শুধু তাই নয়, আমি নতুন করে, আধুনিকভাবে গানগুলো গাওয়ার চেষ্টা করি। এ ছাড়া এই সময়ের বেশকিছু নতুন শিল্পী ভালো ফোক গান করছে। আমি মাঝে-মধ্যে তাদের সঙ্গে স্টেজে গান করি। আমার অনেক ভালো লাগে তাদের গান। সব ভালোর মধ্যে কিছু মন্দ তো থাকতেই পারে, তা নিয়ে আমি ভাবি না।’
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ফোকসম্রাজ্ঞী মমতাজ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় আমাদের সময় ফোক গান যতটা ভালো হতো এখন কোনো অংশে তা কম হচ্ছে না। কেননা নতুনদের মধ্যে একটা বিষয় সব সময় লক্ষ্য করি, তা হচ্ছে তারা অনেক শিল্পীর গান অনুকরণ করে নিজের মতো করে গাওয়ার চেষ্টা করে। তারা খুব ভালো করছে। যা এ ঘরানার গানের জন্য অনেকটা ইতিবাচক দিক। এককথায় বলতে চাই, ফোক ঘরানার গানে পরিবর্তন এলেও গান ভালো হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত প্রকাশ করেন ফোক গানের আরেক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সংগীত হচ্ছে একটি গুরুমুখী বিদ্যা। আমাদের নতুন শিল্পীরা কেন জানি গুরুমুখী হতে চায় না। গানচর্চা করছে না। কেমন যেন একটি অস্থিরতা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। এ ছাড়া টিভি চ্যানেলগুলো তাদের অবসর থাকতে দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটি অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে আমাদের এই গানের জগতে। তার মধ্য থেকে অনেকেই ভালো করছে। আর নতুনদের জন্য আমি ১০১টি ফোক গান করে দিয়ে যাচ্ছি। তারা এই গানগুলো থেকে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারবে।’
লালন কন্যা খ্যাত ফোকশিল্পী ক্লোজআপ তারকা বিউটি। ফোক গান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা বরাবরই তার একটু বেশি। তার কাছে ফোক গানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘ফোক গান হলো মাটির গান। শেকড়ের গান। এ গানের মাধ্যমে আমার আজকের পরিচয় পাওয়া। এমন কিছু ফোক গান করতে চাই, যেগুলো মানুষ আজীবন মনে রাখবে। কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এ ধারায় অনেক ভালো গান হচ্ছে। যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের দেশ, ঐতিহ্যকে বাইরের দেশের কাছে তুলে ধরতে পারছি।’
ফোক গানের হাল আমলের আরেক জনপ্রিয় শিল্পী সালমা। এ ধরনের গান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফোক আমার প্রাণ। যতই ভিন্ন ধরনের গান করার চেষ্টা করি না কেন, আত্মার টানে আমাকে মাটির কাছেই ফিরে যেতে হয়।’ এদিকে নতুন প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই লোকসংগীতের ব্যাপারে আগ্রহের অভাব দেখা যায় বলে মনে করেন সংগীতবোদ্ধারা। কারণ হিসেবে সঠিক পরিকল্পনা, চর্চা এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই এ অনাগ্রহ বলে মনে করেন তারা।