শিরোনাম
৭ আগস্ট, ২০২০ ২০:২১

ওহ, দুঃখিত কি বলছি আমরা তো আবার মানুষও না!

ইফতেখায়রুল ইসলাম

ওহ, দুঃখিত কি বলছি আমরা তো আবার মানুষও না!

ইফতেখায়রুল ইসলাম

সৃষ্টিলগ্ন থেকে বাংলাদেশ পুলিশ বহতা নদীর মত, এর ব্যতিক্রম ইতিহাসেও নেই...! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা মজার ব্যাপার আছে, তাদের নাগরিকগণ যত খুশি অপকর্ম করুন, তারা চায় তাদের প্রেসিডেন্ট পরিপূর্ণ শুদ্ধ থাকুক! এই চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়! কিন্তু একইসাথে একজন মানুষ হিসেবে খুবই অযথা চাওয়া! হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে যারা স্টাডি করেন, তারা ভাল বুঝবেন! ভুল, ত্রুটির ঊর্ধ্বে কেউ নন! জেনে অথবা না জেনে ভুল বা অপরাধ আমরা প্রত্যেকে প্রায়শই করি! মুখে নিয়ম-নীতির কথা বললেও বিশেষ সময়ে নিয়ম মেনে বিদগ্ধজনেরা নিজেরাও থাকতে চান না! অনিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে তারা নিজেরাও নিয়ম ভাঙবেন কিন্তু সেটি নিয়ে আর টু শব্দ হবে না! কারণ ওই যে, আমরা সবাই কম, বেশি ভুল করি এবং এটাই স্বাভাবিক; তারা আর বাইরে থাকবেন কেন? প্রত্যেকেরই কৃত অপরাধের শাস্তি হওয়া উচিত এবং সেটিই প্রত্যাশিত ও বাঞ্ছনীয়! অপরাধীর শাস্তি হলে বরং সমাজ শুদ্ধ হয়!

আমাদের দেশেও মজাটা ঠিক এ্যামেরিকার প্রেসিডেন্টের মত! এখানে সকল পেশার ঊর্ধ্বে শুধু একটি পেশার লোকজনকে বিশুদ্ধ করে ফেলতে পারলেই সকলের শত যাতনা দূর হয়ে যায়! অন্য কাউকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, থাকতেও হয় না! বহুবার বলেছি, অপরাধ প্রবণ সমাজের মানুষ থেকেই যারা বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণ করেন তাদের মাঝে সেই সমাজের মানুষের মত আচরণই উন্মোচিত হবে! কিন্তু শিক্ষকগণ মানতে নারাজ, তারা চান এ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট এর মত শুধুমাত্র একটি পেশায় সবাইকে শুদ্ধ থাকতেই হবে। মাত্র কয় মাস আগেই নিজেদের জান, জীবন উজাড় করে, জীবন উৎসর্গ করে একের পর এক ভিন্নতর কাজ উপস্থাপন করা সত্ত্বেও, সবকিছু এক মুহূর্তে ভুলে গিয়ে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায় পুরো পেশার, প্রতিটি মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে খিস্তিখেউড় ও গালিগালাজের পসরা সাজিয়ে বসলেন বিশুদ্ধতায় পূর্ণ মানুষজন!

আমাদের আসলে আজকাল আর কষ্ট হয় না! কারণ খিস্তিখেউড় প্রাপ্তি আমার পেশার সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়! কেন? হাজারটা কারণ থাকলেও কয়েকটি কারণ একটু দেখিয়ে যাই।

১) সর্বদাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যারা থাকেন তাদের বিশাল একটা অংশ সবসময় আমাদের বিপরীতে থাকে! শতকরা হিসাব দাঁড় করালে সে সংখ্যা মোটেও কম নয়! রাষ্ট্র বিরোধী এই পক্ষ জীবনেও আমাদের গুণগান তো গাইবে না, এরা শুধু সুযোগই খুঁজবে, সুযোগ পেলে সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং অন্য বিদগ্ধজনদেরও অনুপ্রাণিত করবেন!

২) অসংগতিপূর্ণ সমাজের অসংগতিতে ভরা মানুষজনের সঠিক চেহারা আমরা অনেকটাই দেখি! তাদের অনেক চেষ্টা থাকে আমাদের দেখতে পারা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেটি করাতে ব্যর্থ হলে, খিস্তিখেউড় এবং অপছন্দের তালিকায় আবারও আমরা।

৩) জায়গা-জমির সমস্যা, মারামারি, হানাহানি, ধর্ষণ, ডাকাতি, দস্যুতা, চুরি, ধর্ষণ, মাদক ও হত্যাসহ যত অপরাধ এই সমাজে সংঘটিত হয় এবং যারা এর সাথে জড়িয়ে থাকেন তারা এবং তাদের পরিবারের চক্ষুশুল আমরা সবসময় ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আহা ভাল মানুষজন এই অপরাধ করা বন্ধ করে দিলে হয়তোবা শতকরা হিসাবে আমাদের অপছন্দ করা লোকের সংখ্যা সাগর থেকে এক ফোঁটা জল সরিয়ে নেয়ার মত কিছুটা কমতো! কত ভালই না হতো!

৪) রাষ্ট্র ও সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রু সকলের কাছে সবসময় চক্ষুশুল আমরা! কাজেই গালিগালাজের মত বিশেষ পসরার শক্ এ্যাবজরবার আমরাই হবো সেটাই তো স্বাভাবিক!

৫) কখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকের জনপ্রিয় হয়ে উঠার পেছনের মূল হাতিয়ার হই আমরা! এই যেমন ধরেন, আমাদের নিয়ে খারাপ কথা বললে সহজে খাওয়ানো যায়! প্রতি বছরে আমাদের বিষয়ে কয়েকটি ভাল বার্তা যেটি দেয়া হয়, সেটি আদতে আমাদের মঙ্গলের জন্য নয় বরং বই, পুস্তক পাঠদানের মত বুঝানোর চেষ্টা করা হয়, জানেন ভাল মানুষ এই পেশায় আছে কিন্তু তা খুব অল্প! যদিও ধারণা প্রসূত এই বিষয়ে কোনো জরিপ নেই, কিচ্ছু নেই! এমনকি কেউ যদি ভুলক্রমে জরিপ চালিয়ে, বার্ষিক জরিপে, আমাদের অবস্থান পাঁচ অথবা ছয়ে দেখিয়ে ফেলেনও তথাপি আলোচনার কেন্দ্রে সবসময় আমরাই থাকি এবং এবং থাকবো! কারণ সর্বদাই সৌভাগ্যের প্রতীক আমাদের ললাটেই যে সেঁটে থাকে! আমাদের আলোচনায় রাখাটা কারো কারো এক ধরণের স্ট্র্যাটেজিও বলতে পারেন!

৫) নাটক, সিনেমা, চলচ্চিত্র প্রতিটি ক্ষেত্রে যুগের পর যুগ আমাদের ভিন্নতর উপস্থাপন! অনেকের সত্য, মিথ্যে এবং সত্য-মিথ্যার মিশেলে গালগল্প যা কিছুই বলেন, সবকিছুই আমাদের বিপরীতে! তাই আমাদের নিয়ে যতটুকু প্রশংসাসূচক ধ্বনি বা বর্ণনা সেটিও আসলে আমাদের যতটুকু অসংগতি বা মন্দ সেটিকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করার একটি প্রয়াস মাত্র!

৬) মানুষ স্বভাবজাতভাবেই ক্ষমতার প্রতি মোহাবিষ্ট, তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কাউকে সব সময় সহজে নেয়ার মানসিকতা থাকে না। অনেকটা না পাওয়ার বেদনা থেকেও এমনটা হয়! না, না এসব আমি বলি না! এসব মন্দ কথা সমাজবিজ্ঞান বলে! এটা দোষের কিছু নাহ! এই শ্রেণিরও সবসময়ের চক্ষুশুল আমরা! শতকরা হিসাবটা কি এইদিক দিয়েও দেখিয়ে যাবো?

৭) ইদানিং বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে চাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী বিদগ্ধজন না পাওয়ার বেদনা থেকেও বিভিন্নভাবে খিস্তিখেউড় করেন; আর সবকিছুর বড় কথা দৃশ্যমান প্রভাবককে গালি দেয়া খুব সহজ, এতে আত্মতুষ্টি ও তৃপ্তি দুই-ই আসে! অন্য অনেক বড় ক্ষতিও তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়, বড়জোর ১-২ দিনের বিষয়। কিন্তু একটি পেশা সবসময়ই হটকেক। ধরতে পারলেই মনে হয়, পুরোটাই ধরে ফেললাম বুঝি, এবার সবাই মিলে লেবু চিপড়ে শেষ করে দিতে পারলেই আসবে প্রত্যাশিত শান্তি! কারণ এই পেশা ছাড়া বাকি সকলেই বিশুদ্ধতার মূর্ত প্রতীক!

৮) শিক্ষিত ও অশিক্ষিত শ্রেণিভুক্তের মাঝে একটি গ্রুপ আছেন যারা আইন জানেন না, জানলেও মানেন না! তাদের একটি গোষ্ঠী মনে করেন, আসামি গ্রেফতারের পর তাকে আইনি কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পর জামিন হওয়া, না হওয়া ও শাস্তি হওয়া না হওয়া পুরোটাই শুধুমাত্র একটি পেশার কাজ! যখনি কেউ আইন অনুসারে জামিন লাভ করেন বা শাস্তি প্রত্যাশিত মাত্রায় না হয় তখন সেই বিদগ্ধ বিশেষজনেরা শুরু করেন আবারও খিস্তিখেউড়! কাঠগড়ায় দাঁড় করায় আবারও একমাত্র অবিশুদ্ধ পেশার মানুষজনকে! আইন না জেনে আইনের বিষয়ে যারা অবগত তাদেরকে প্রচুর আইন শেখাবেন কারণ তাদের আছে কি বোর্ড, মোবাইল বাটন আর ফেসবুক! বিদ্যমান আইনের সাথে তার বক্তব্য অসংগতিপূর্ণ হলেই বা কি আসে যায়!

৯) যে সমাজ ভাল-মন্দের মিশেলে গঠিত, সে সমাজের প্রত্যেক পেশায়, সমাজে বসবাসরত মানুষের মতই বিষফোঁড়া থাকবে সেটাও স্বাভাবিক! সমাজের মানুষের মত এদের কিয়দংশের অতি উৎসাহী আচরণ কখনো কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এখানেও একটি মজা আছে, এদের অনেকেই ক্রমাগত শাস্তির আওতায় আসে বিভিন্ন আঙ্গিকে, সেটি নিয়েও সমালোচনা হবে! অন্য কোনো সেক্টরে কোনো শাস্তি দেয়া হয় কিনা বা কতটাই বা শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, তা নিয়ে বিদগ্ধজনের যদিও কোনো মাথা ব্যথা নেই! এত ছোট একটি মাথায় একটি বিশেষ পেশা নিয়েই তো পূর্ণ আছে অন্য সেক্টর নিয়ে ভাবনার সময় কোথায় তাদের? যার ফলে আবারও খিস্তিখেউড় শুধু একমাত্র অবিশুদ্ধ পেশাজীবীদের নিয়ে।

১০) জীব হিসেবেই নিয়ম ভাঙা প্রাণি আমরা! আমাদের শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকল মানুষজন কেউই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না তারা নিয়ম অথবা আইন ভাঙেননি বা ভাঙেন না! এখন এই নীতিতে অটল বিশ্বাসীজনকে আপনি নিয়ম মানাতে চাইলে, আপনি আবারও চক্ষুশুল! হাজারো উদাহরণ পাঠক নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন! কাগজপত্র বিহীন মোটরসাইকেল পুলিশ আটকালে, কাকে ফোন দিয়ে ছুটাবেন সেই চেষ্টা, সঠিকভাবে কাজ করতে চাওয়া অফিসারের সামনে একের পর এক প্রভাবশালী আত্মীয়ের উদাহরণ টেনে বিব্রত করা, এক অপরাধকে আরেক অপরাধ দিয়ে ডিফেন্ড করা, কিছুই না পারলে চারিত্রিকভাবে ডিফেইম করাসহ এমন কী নেই যা আমাদের স্বাভাবিক কাজের গতিকে বাধাপ্রাপ্ত করতে করা হয় না! অথচ অন্য অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কাজটুকুই কেউ কেউ করছে কিনা, তা নিয়ে বিদগ্ধজনেরা বছরে একবার একটু মুখ খুললেই দায় শেষ হয়ে যায়! না অন্য কাউকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই! নিজ ও সামাজিক অসংগতিতে পূর্ণ এই সমাজ যদি প্রত্যাশা করে উপর্যুক্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন এবং ঘরে ঘরে ফেরেশতাস্বরুপ প্রত্যাশিত পেশার মানুষজন চাইবেন তবে তাহা আত্মপ্রবঞ্চনা নয় কি?

এত এত ঝড়, ঝঞ্ঝা নিয়ে যে পেশার লোকজন প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের কপালে ভালবাসার স্তুতি যেটুকু জুটে তা নিতান্তই পরবর্তী কাজটুকু সুন্দরভাবে সম্পাদন করিয়ে নেবার প্রত্যাশায়! হুম, শুনতে খারাপ শোনালেও চেতনে ও অবচেতনে সেটাই প্রকৃত বিষয়! বিশ্বাস নাহলে নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন।

শ্রদ্ধার্ঘ্য আর পুস্পার্ঘ্য সেসব আবার কি জিনিস? এসব তো এলিট সম্প্রদায়ের জন্য, আমাদের মত রাস্তা, ঘাটে খেটে খাওয়াদের জন্য নয়! ওহ, দুঃখিত কি বলছি আমরা তো আবার মানুষও না!

মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে করোনা যুদ্ধ এবং তারপর আরো হাজারো যুদ্ধ চলবে আর সেখানে একটি পেশার লোক জীবন উৎসর্গ করে যাবে, নিজেদের সর্বোচ্চ ও সর্বস্ব বিলিয়ে যাবে তথাপি মানুষ নামের স্বীকৃতিটুকু জুটবে না! তবে কি জানেন, "ছদ্মবেশী যে মানুষ পরিচয়" সেটি চাইও না, সেটি বরং আপনারই থাক! না থাকলে কথা বলার মত মহৎ কাজটুকুও যে আপনার হারিয়ে যাবে! কিছু একটা করতে তো হবে তাই না?

চাকরিতে যখন এসেছি তখন শুনেছিলাম চাকরির বৈশিষ্ট্যগুণে সমাজের ৫০ ভাগ মানুষ সবসময় আমাদের বিপরীতে থাকবে! এই লেখা প্রমাণ করে যাবে, কতটা ভুল শিখেছি, সমাজের ৫০ ভাগ নয় বরং তারও কয়েকগুণ বেশি মানুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের পেশাগত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় এবং হবে! সিনিয়র স্যার সবসময় বলতেন, তুমি যখন কাজ করবে, তোমার তখন ভুলও হবে, সমাজ তোমার কাছে বিশুদ্ধতা চাইবে কিন্তু সমাজের নিজেকে বিশুদ্ধ করতে যা যা করা দরকার সেই মূল জায়গায় আঘাত কখনোই করবে না! কারণ এই বৈপরীত্যে সমাজ নিজেও এক ধরনের পুলক অনুভব করে! শুনি আর বিস্মিত হয়ে ভাবি সত্যি কি তাই?

আহা! এত এত ভাল মানুষের ভিড়ে আমাদের সমাজের এ কি দশা? এত এত ভাল মানুষের ভিড়ে আমার মানুষ পরিচয় আজীবনের জন্য মুছেই যাক, ক্ষোভ নেই, থাকবেও না! যে পেশার দায়িত্বের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ প্রতিনিয়ত নিজের জীবন বিসর্জন তথা মৃত্যু, সেই পেশায় থেকে তথাকথিত বিদগ্ধজনের মেকি ভালবাসাটুকু নাইবা জুটলো আমাদের কপালে...!

সৎ মায়ের অপ্রিয় সন্তানরা কি তাই বলে কাজ থামিয়ে দেবেন? না, কখনোই না! পৃথিবী নামের ঘড়ির কাটা যখন থামবে, তখনি হয়তো তার স্থিরতা আসবে! দায়িত্ব প্রাপ্তির পর থেকে আজ অবধি বহতা নদীর মত বহমান 'বাংলাদেশ পুলিশ', এর ব্যতিক্রম উদাহরণ ইতিহাসেও নেই...!

লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, পল্লবী জোন গোয়েন্দা বিভাগ (ডিএমপি)।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

সর্বশেষ খবর