২১ নভেম্বর, ২০২২ ১২:৪৭

‌‌‘আপনি ভালো মানুষ, আপনার হাসি দেখেই বোঝা যায়’

আবুল হাসনাত মিল্টন

‌‌‘আপনি ভালো মানুষ, আপনার হাসি দেখেই বোঝা যায়’

আবুল হাসনাত মিল্টন ও জয় গোস্বামী

হঠাৎ করেই অনলাইনে ভিসা করে কোলকাতা চলে এলাম। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, প্রিয় কয়েকজনের কবির সাথে দেখা করা। কবি অমিত গোস্বামীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে প্রথমেই ফোন করলাম বাংলা ভাষার উত্তর-জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয়, ভারতীয় পশ্চিম বাংলার কবি জয় গোস্বামীকে। অচেনা নম্বরের কল তিনি ধরবেন কি না, এই নিয়ে সংশয় ছিলো। অথচ কয়েকবার রিং বাজতেই তিনি ফোন ধরলেন। আমার ইচ্ছের কথা বলতেই কোলকাতায় কদিন আছি জানতে চাইলেন। উত্তর শুনে বললেন, আজ দুপুর আড়াইটায় বাসায় চলে আসুন। আমি আসবো বলে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখতে যাবার মুহূর্তে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বাসার ঠিকানা নেবেন না? আমি বললাম ঠিকানা লাগবে না দাদা, আমি যোগাড় করে নেবো।

এবার কোলকাতায় এসে প্রথম দিন ভুল হোটেলে উঠেছি। বন্ধুকে যে হোটেলটা বুক করতে বলেছিলাম, নামের আংশিক মিল দেখে সে অন্য একটি হোটেল বুক করে রেখেছে। ভুল হোটেলটা খুব যে খারাপ তা নয়, তবে আমি এর চেয়ে আরেকটু ভালো হোটেলে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। প্রায় সারারাত নিদ্রাহীন কাটিয়ে পরেরদিনই হোটেল বদলালাম। নতুন হোটেলটা ভালো, কর্তৃপক্ষের বদান্যতায় চেকইন সময় দুপুর বারোটার দুঘন্টা আগেই রুমের চাবি দিলেন।

নতুন হোটেলের রুমে উঠে স্নান সারলাম। এর মধ্যে কবি অমিত গোস্বামীও এসে হাজির। অমিত দা ‘ইন ড্রাইভ’ অ্যাপস ব্যবহার করে হোটেলের সামনে ট্যাক্সি আনালেন। আমরা দুজন হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তা থেকে ট্যাক্সিতে চড়লাম। শনিবার দুপুরের কোলকাতার রাস্তাগুলোয় তেমন যানজট নেই।

ট্যাক্সিতে চড়ে কবি জয় গোস্বামীর বাসার সামনে যখন পৌছালাম তখনো আড়াইটা বাজতে ত্রিশ মিনিট বাকি। রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাতের ভাতের হোটেলটা ততক্ষণে জমে উঠেছে। টেবিলের উপরে মাছ, কুচো চিংড়ি, মুরগী, সব্জি, ডালসহ বাহারি রকমের  তরিতরকারী সাজিয়ে রাখা। দেখে খাবার খুব লোভ হলো, তবু ডায়রিয়া হবার ভয়ে খেলাম না। দেরি হতে পারে ভেবে আমি এবং অমিত, দুজনেই দুপুরের খাবার না খেয়েই হোটেল থেকে বেরিয়েছিলাম। ফুটপাতের দোকান থেকে অমিত দা’র কলেজ জীবনের প্রিয় কেক আর লাড্ডু দিয়েই লাঞ্চ সারলাম।

আড়াইটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই কবির ফ্লাটের কলিংবেল টিপলাম, দরজা খুলে নাম শুধোলেন কবিপত্নী কাবেরি গোস্বামী। আমাদের ড্রয়িংরুমে বসতে বলে পাশের বদ্ধ রুমের দরজায় টোকা দিয়ে বললেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে ড. মিল্টন এসেছেন। ভেতর থেকে তিনি আমাদের বসতে বললেন। কবির বাসার ছোট্ট ড্রয়িংরুমটা নানা লেখকের বইয়ে ঠাসা।

পাঁচ মিনিট পরে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে করতেই সোফায় বসলেন কবি জয় গোস্বামী। এতক্ষণ বিখ্যাত সেতারবাদক ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ’র একটা সাক্ষাতকার শুনছিলেন। সেটা শেষ করেই তিনি এলেন।

কবিদের সাথে সাহিত্য নিয়ে গভীর আলোচনা করাটা কেন জানি আমার হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া আজকাল আর আগের মত প্রিয় কবিতাগুলো অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারি না। জয় গোস্বামীর বেশ কিছু কবিতার কয়েকটা লাইন অবশ্য আজো মনে আছে।  বর্তমান বাংলা সাহিত্যের  এত বড় মাপের একজন কবির সাথে ঠিক কীভাবে আলাপ শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না।

শুরুতেই তিনি বিলায়েত খাঁর সাক্ষাতকারটা শেষ করতে গিয়ে সামান্য বিলম্বের কারণে বারবার দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। আমি বললাম, আমাদের কালের একজন বিখ্যাত কবির কাছে, আমার খুব প্রিয় একজন কবির কাছে আমার মুগ্ধতার কথা জানাতেই মূলত আমি এসেছি। তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন, আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করলেন। নিজেকে তিনি বড়মাপের কবি মানতেই নারাজ। তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যয়ের কথা বললেন, কাজী নজরুলের কথা বললেন, বিনয় মজুমদারের কথা বললেন, ভাষ্কর চক্রবর্তীর কথা বললেন, আরো অনেক কবির কথা বললেন। সেই তেরো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন বর্তমানে ৬৮ বছরের জয় গোস্বামী। তবু নিজেকে বড় মাপের তো দূরের কথা, কবি বলে মানতেই দ্বিধান্বিত, এতটাই তার বিনয়। বিদেশের জীবনে আমি বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, সবার ক্ষেত্রেই বিনয় দেখে আমি যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি জয় গোস্বামীও তার ব্যতিক্রম নন। কথা প্রসঙ্গেই বললেন, এই তো গত সপ্তাহেই সকাল নয়টা থেকে শুরু করে বিকেল তিনটে-চারটে পর্যন্ত ২৩/২৪ লাইনের একটা কবিতা লিখতে গিয়ে বুঝতেই পারলাম না কবিতাটা কোন লিঙ্গের। এতক্ষণ চেষ্টা করেও আমি কবিতাটা শেষ করতে পারি নি, তাহলেই বুঝুন আমি কেমন কবি? আমি মনে মনে বলি, এজন্যই তো এরা কবিতা। চাইলে হুট করে লিখে ফেলা যায় না। আবার কখনো কখনো অনর্গল শব্দের জন্ম হতে থাকে। তিনি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, আত্মা থেকে উৎসারিত অগ্নির নাম কবি। সুতরাং কবি হওয়া কি এতই সহজ? আমার তখন জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটার কথা মনে পড়ে। ‘বেনী মাধব, আগুন জ্বলে কই?’ আহারে আগুন! কবিতার আগুন। যে আগুন কবিকে পোড়ায় সারাটা জীবন।

আমাদের আড্ডাটা ক্রমশ জমে উঠতে থাকে। কবিতা থেকে শুরু করে সঙ্গীত, অভিনয়, বাংলাদেশের নাটক থেকে শুরু করে অভিনেতা পর্যন্ত সে আলাপ গড়ায়। বর্তমানে অবসর জীবনে বই পড়ে, সিনেমা-নাটক দেখে, কবিদের সাথে ছন্দসহ নানান বিষয়ে আলোচনা করে এবং লেখালেখি করে তার অধিকাংশ সময় কাটে। এর মধ্যে এক ফাঁকে হঠাৎ করেই তিনি বলে বসলেন, ‘আপনি ভালো মানুষ, আপনার হাসি দেখেই বোঝা যায়।’

বাংলাদেশের নাটকের কথা বলতে গিয়ে তিনি মোশাররফ করীম আর চঞ্চল চৌধুরীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। নিজের বেডরুম থেকে আইপ্যাডটা নিয়ে এসে মোশাররফ করীমের ‘দানব’ নাটকটার একটা দৃশ্য দেখিয়ে বললেন, সংলাপবিহীন অভিব্যক্তিটা দেখুন না। একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছেন মোশাররফ করীম। সময় পেলে আমাকে মোশাররফ করীমের ‘যে শহরে টাকা ওড়ে’ আর ‘অমানুষ’ নাটক দুটো দেখতে বললেন।

কথা প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের প্রশংসায় মেতে উঠলেন। তাঁর মতে, বাঙালির শক্তির উৎস হলো তাদের তীব্র আবেগ। ভাষাকে কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া একটা জাতি আবেগের বশে একের পর এক দুঃসাধ্য সাধন করে চলেছে। তিনি এখনো প্রচুর পড়াশুনা করেন। অনেক আগে তিনি সিডনি ও মেলবোর্ণ গিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গেও কথা বললেন কিছুক্ষণ। সিডনি প্রবাসী বাংলাদেশী কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের খোঁজ নিলেন। অনেকদিন সুব্রত দা’র সাথে যোগাযোগ নেই বলে জানালেন। আমি বললাম, কয়েক বছর হলো আমিও সুব্রত দা’কে হারিয়ে ফেলেছি। কী এক দুর্বোধ্য কারণে প্রবাস জীবনে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ বরাবরই নিজেকে আড়ালে রাখতেই ভালোবাসেন।

এক পর্যায়ে নিজের আসন থেকে উঠে গিয়ে কোলকাতার বিখ্যাত অভিনেতা শম্ভু মিত্রর লেখা বই ‘সন্মার্গ সপর্যা’ বইটি হাতে নিয়ে একটি পৃষ্ঠা খুলে আমাকে দেখালেন। সেখানে লেখা, ‘’অভিনয়ের কেন্দ্রে, আমার মনে হয়, একটি সম্পর্কের কথা আছে। মানুষের নিজের কী সম্পর্ক, আর তার সমাজের সঙ্গেই বা তার কী সম্পর্ক।’ তিনি বললেন, অভিনয়ের পরিবর্তে আপনি কবিতা শব্দটি বসিয়ে দেখেন। সেখানেই কিন্তু আপনি সম্পর্কের কথা পাবেন। মানুষের সাথে কবির নিজের কী সম্পর্ক, আর সমাজের সাথেই বা তার কী সম্পর্ক। তিনি আবার মোশাররফ করীম প্রসঙ্গ এনে বললেন, ওরও উচিত হবে একটা বই লেখা। ওর অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ও কথা বলে রেকর্ড করবে, তারপর ভালো কাউকে দিয়ে প্রয়োজনে লিখিয়ে নেবে। পরে পান্ডুলিপির খসড়া দেখে কারেকশন করে দেবেন। জয় গোস্বামীর মতে, বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা মোশাররফ করীম। আমি বললাম, এবার দেশে গিয়ে মোশাররফ করীমকে আপনার কথা জানাবো। ওনাকে বলবো, আপনাকে ফোন করতে। এ কথা শুনে তিনি শিশুর মত খুশী হয়ে উঠলেন। আড্ডার ফাঁকে চা এলো। আমেরিকা থেকে কবির বাসায় চলচ্চিত্র বিষয়ের শিক্ষক অনামিকা বেড়াতে এসেছেন। তিনিও মাঝেমধ্যে আড্ডায় যোগ দিচ্ছিলেন।  শেষ দিকে আমি আমার দুটো কাব্যগ্রন্থ ‘এত ভালো তুমি না বাসলেও পারতে’ এবং ‘আকণ্ঠ ডুবে আছি মুগ্ধতায়’ কবির হাতে সসংকোচে তুলে দিলাম। তিনি বই দুটো হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, আমি বই দুটো পড়বো।

সাক্ষাত শেষে জয় গোস্বামীর বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কবিতা একাডেমির চেয়ারম্যান কবি সুবোধ সরকার। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও তিনি অফিসে এসেছেন, আমার সাথে দেখা করতে সদয় সম্মতি দিয়েছেন। এর মধ্যেই কবি অমিত গোস্বামী বলে উঠলেন, ‘আমি গত চল্লিশ বছর ধরে জয় গোস্বামীকে চিনি। আমি তাকে কখনো এই মাত্রার আলোচনা করতে দেখি নি। আজ আমাদের ওঠার তাড়া না থাকলে এই আড্ডা রাত দশটা অবধি চলতো।’

আমার চোখে-মুখে তখনো গভীর ঘোর। দুইঘণ্টা সময় কত দ্রুত চলে গেলো। এক জীবনে এমন সময় এর আগে খুব বেশি আসেনি আমার! 
১৯ নভেম্বর, ২০২২
কোলকাতা, ভারত

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর