শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

সাইয়িদ আতীকুল্লাহ ও বুধবার রাতে

ইমদাদুল হক মিলন

সাইয়িদ আতীকুল্লাহ ও বুধবার রাতে

লেখালেখির শুরু থেকেই জেনেছিলাম সাইয়িদ আতীকুল্লাহ নামে দুর্র্ধর্ষ একজন গল্প লেখক আছেন।

একটি মাত্র গল্পের বই আছে তাঁর ‘বুধবার রাতে’। বইয়ের প্রতিটি গল্পই অসাধারণ।

যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় যে কোনো ভালো বইয়ের কথা শুনলে সেই বই জোগাড় করার চেষ্টা করতাম, যে কোনোভাবে বইটি পড়ে ফেলতাম।

‘বুধবার রাতে’ও জোগাড় করলাম। বাংলাবাজারের মাওলা ব্রাদার্স নামের বেশ নামকরা একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে বেরিয়েছে। কিন্তু প্রথমবার পড়ে গল্পগুলোর মাহাত্ম্য সেভাবে উদ্ধার করতে পারলাম না। ‘এক সকালে রাজার লোক, রোজ সকালে’ এবং ‘বুধবার রাতে’ এই দুটো গল্প আবার পড়লাম। দ্বিতীয় পাঠের পর বোঝা গেল এই লেখক একটু অন্য ধাঁচের। প্রচলিত লেখকদের মতো নয় তার স্টাইল, এই দুটো মাত্র গল্প পড়ে যে কোনো মনোযোগী পাঠকের বিশেষ একটি সমীহ তৈরি হবে লেখকের ব্যাপারে। এই লেখককে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।

তারপর থেকে ‘বুধবার রাতে’র লেখক আমার মনে বিশেষ একটি জায়গা দখল করে ছিলেন। বোধহয় আরও দুবার বইটি আমি পড়েছি। কিন্তু লেখককে ব্যক্তিগতভাবে তখনো পর্যন্ত চিনি না। চোখেও দেখিনি তাকে। কত জনকে চিনেছি, কত জনকে দেখেছি সাইয়িদ আতীকুল্লাহকে আর দেখি না।

প্রথম দেখা ‘রোববার’ পত্রিকায় কাজ করার সময়। আটাত্তর সালের কথা। দিনটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বেরোবে। রফিক আজাদ, অসীম সাহা এবং আমি লেখা জোগাড় করছি। এক দুপুরে এই তিনজন গিয়ে হাজির হলাম জনতা ব্যাংকের হেড অফিসে। সাইয়িদ আতীকুল্লাহ তখন এই ব্যাংকে বেশ বড় চাকরি করেন। যতদূর মনে পড়ে, ব্যাংকের বিজ্ঞাপন ইত্যাদির ব্যাপারটি তার হাতে ছিল। দোতলা কিংবা তিনতলায় চমৎকার রুমে বসেন। সেদিন বিনবিন করে এসি চলছিল তার রুমে। আমরা তিনজন গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। রিভলবিং চেয়ারে বসে আছেন ছোটখাটো মানুষটি। সামনে গ্লাসটিপ টেবিল। টেবিলে কী একটা পত্রিকা। মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা দেখছেন। হাতে সিগ্রেট। আমাদের দেখে চোখ তুলে তাকালেন। অসম্ভব শীতল এবং নির্বিকার চোখ। তিনজন মানুষের দুজন খুবই পরিচিত তাঁর রফিক আজাদ এবং অসীম সাহা। শুধু আমিই অপরিচিত। পরিচিত মানুষ দেখলে মানুষের চেহারায় নিজের অজান্তে হলেও একটা পরিবর্তন হয়। রফিক আজাদ এবং অসীম সাহাকে দেখে কিছুমাত্র পরিবর্তন হলো না তাঁর চেহারায়। নির্বিকার গলায় বললেন, বসো। আমরা বসলাম। চা এলো। তিনি তখনো পত্রিকা দেখছেন। অনেকক্ষণ কোনো কথা নেই।

আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ নিজেও তাঁর গল্পের মতোই ভিন্ন ধাঁচের। আমার খুব কৌতূহল হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করি, আপনি আর গল্প লেখেন না কেন? ঠিক এ সময় রফিক আজাদ তাঁর কাজ সারতে চাইলেন। অতি বিনয়ের গলায় বললেন, আপনার কবিতা নিতে এসেছি আতীক ভাই।

আমার যে কী হলো, কিছু না বুঝে অতি উৎসাহিত গলায় বললাম, কবিতা কেন? আতীক ভাইয়ের গল্প নেব আমরা।

সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, রফিক আজাদ এবং অসীম সাহা ততক্ষণে মাথা নিচু করে ফেলেছেন।

তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার নাম কী?

নাম বললাম। এতদিনে আমার নাম অনেকেই জানে। আতীক ভাই নিশ্চয় জানতেন, কিন্তু পাত্তা দিলেন না। বললেন, আমি এখন আর গল্প লিখি না, চাইলে কোনো লাভ হবে না। এই সুযোগে ব্যাপারটা সামাল দিলেন রফিক ভাই। বললেন, ও জানে না তো, এ জন্যে বলে ফেলেছে। আপনি রাগ করবেন না। বেরিয়ে আসার পর রফিক ভাই বললেন, সর্বনাশ করেছিলে মিয়া। গল্পের কথা শুনলে ভয়ঙ্কর রেগে যান আতীক ভাই, গল্প লেখা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এখন কবি। সত্যি সত্যি আতীক ভাইকে আর কখনো গল্প লিখতে দেখিনি। কেন যে আর গল্প লিখলেন না তিনি! কবিতার পাশাপাশি গল্পও যদি লিখতেন, আমাদের গল্পের ভুবন কত সমৃদ্ধ হতো।

সেই পরিচয়ের পর থেকে মাঝে মধ্যে দেখা হয়েছে আতীক ভাইয়ের সঙ্গে। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতায় চলে আসেন তিনি। দিনমান আড্ডা দিতেন প্রেস ক্লাবে। অসম্ভব মেজাজি এবং গম্ভীর মানুষ। আমি খুব ভয় পেতাম তাঁকে। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ যখন কৃষিমন্ত্রী তখন রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইন এবং আরও অনেকে মিলে কবি সংগঠন ‘পদাবলী’ করেছিলেন, পদাবলীর এক কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান শেষে সেন্টু ভাইয়ের (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ডাকনাম) বাসায় পানাহারের ব্যবস্থা। আমরা সবাই আছি, আতীক ভাই এসেই সেন্টু ভাইকে কী এক কারণে বেশ একটা ধমক দিলেন। সেন্টু ভাই তাঁর বন্ধু, বন্ধুর ধমক তিনি গায়েই মাখলেন না । হাসতে লাগলেন। কিন্তু আমি খুব ভড়কে গেলাম। বাপরে, মন্ত্রীর বাড়ি ঢুকে মন্ত্রীকে এমন ধমক! এ শুধু আতীক ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব। ভাবা যায়, সেই মানুষটি আর আমাদের মধ্যে নেই! আততায়ী মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। মৃত্যু এমন এক অমোঘ নিয়তি, মানুষের সাধ্য নেই তাকে এড়াবার। আতীক ভাই নেই, তাঁর ‘বুধবার রাতে’ আছে, এই তো তাঁর বেঁচে থাকা।

সর্বশেষ খবর