দু’দিন আগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল বেগে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবল’। আমার জন্মস্থান ভোলাসহ ‘৫টি জেলাকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে ‘১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত’ জারি করে মোট ১৩টি জেলায় ব্যাপক সতর্কতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সরকার। আমাদের ভোলায় ৩ লাখ ২৩ হাজার লোককে আর সারা দেশে সর্বমোট ১৮ লাখ লোককে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে যখন প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝা দুর্যোগ-বিপর্যয় নেমে আসে, তখন স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ছবি। সেদিন ভয়ঙ্কর সেই বিপর্যয় মোকাবেলায় আমাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। কারণ আমরা ছিলাম পরাধীন, পাকিস্তানের অধীন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ না করলে, আজ হয়তো আমাদের অবস্থা হতো রোহিঙ্গাদের মতোই। ’৭০-এর ১২ নভেম্বর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলে ৫ লক্ষাধিক আর ভোলাতে ৫ লক্ষাধিকসহ মোট ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে। অনেক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়; অনেকে আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে নিঃস্ব হয়। প্রতি বছর যখন ১২ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে, তখন বেদনাবিধুর সেই দিনটির কথা গভীরভাবে মনে পড়ে।
সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত ছিলাম আমার এলাকায়। কয়েকদিন ধরে গুমোট আবহাওয়া, বৃষ্টি এবং সেইসঙ্গে ছিল ঝড়ো বাতাস। এরকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই ভোলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া, মওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজুর রহমান মিয়া ও রিয়াজউদ্দীন মোক্তারসহ অন্যান্য নেতাদের নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকাসহ ভোলায় ব্যাপক গণসংযোগ করি। আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ভোলা থানা, দৌলত খাঁ থানা, তজুমুদ্দী থানা এবং মনপুরা। আরেকটি এলাকা ছিল বোরহানউদ্দিন, লালমোহন এবং চরফ্যাশন। নির্বাচনী এলাকাটি বড় ছিল। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু যখন আমাকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন তখন আমার বয়স মাত্র ২৬।
’৬৯-এর উত্তাল গণআন্দোলনে যে গণবিস্ফোরণ ঘটে তাতে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাসীন হন। এ সময় মার্শাল ল’র মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে সামরিক কতৃপক্ষ জুন মাস থেকে ঘরোয়া রাজনীতি দেয়। ’৭০-এর জুনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। ’৭০-এ ১ জানুয়ারি রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর থেকে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহৃত হয়। তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসুর ভিপি। ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমার নেতৃত্বে সেদিন প্রথম জনসভা করি পল্টনে। তখনই বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সব এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিব।’ এই কথাটা ভীষণভাবে আমার হৃদয়কে আলোড়িত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ভোলা সফরে যাই এবং ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে-তখন ভোলায় রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না,-ব্যাপকভাবে গণসংযোগ চালাই। বঙ্গবন্ধু ১,৭০০ টাকা দিয়ে একটা মোটরবাইক কিনে দিয়েছিলেন। এই মোটরবাইক ছিল আমার বাহন। ভোলার মনপুরার সম£ান্ত পরিবারের ব্যক্তি বসরতউল্লাহ চৌধুরী-আমরা যাকে শাহজাদা ভাই বলে শ্রদ্ধা জানাতাম-তার একটি জিপ ছিল। এই জিপটি তিনি আমার নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। এই জিপটি নিয়েই তিনি ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতে চলে যান এবং নয়টি মাস আমার সঙ্গে থেকে সক্রিয় ছিলেন। তারই কৃতিসন্তান জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নাজিমউদ্দীন চৌধুরী। এপ্রিল মাসে ভোলার সাতটি উপজেলায় নির্বাচনী সভা করি। কখনো পায়ে হেঁটে কখনোবা মোটরবাইক চালিয়ে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে। শামসুদ্দীন চাচা, মাওলানা মমতাজুল করিম, মোস্তাফিজ মাস্টার, রিয়াজুদ্দীন মোক্তার-চারজন প্রবীণ নেতাকে নিয়ে সব জায়গায় যেতাম। আমি ছিলাম ছোট। বয়স কম। বয়স্ক নেতাদের নিয়ে গেলে মানুষ সন্তুষ্ট হতো। যেখানে যেতাম মানুষ আমাকে দেখতে চাইত। সময়টা ছিল ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর। যে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলাম। ভোলার যেখানে গিয়েছি হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। তাদের সামনে বক্তৃতা করেছি। এভাবে যখন ১৭ এপ্রিল সাতটি জনসভা শেষে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাবাকে জানালাম, বাবা, বঙ্গবন্ধু আমাকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এমএনএ পদে মনোনয়ন দিতে চেয়েছেন। তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তুই এত অল্প বয়সে এমএনএ হবি। তোর বয়স মাত্র ২৬। আর আমার পরিবারের কেউ কোনো দিন রাজনীতি করেনি। এমনকি ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বারও কেউ হয়নি। তুই একসঙ্গে এমএনএ হয়ে যাবি।’ আমি বাবার দোয়া নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৫ এপ্রিল আমার জনসভা ছিল চট্টগ্রামের মিরেরশ্বরাই। যেখান থেকে সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তখন ’৭০-এ এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) পদপ্রার্থী এবং আমাদের ফজলুল হক বিএসসি সাহেব এমএনএ (জাতীয় পরিষদ সদস্য) পদপ্রার্থী। মিরেরশ্বরাই’র জনসভায় আমাদের প্রিয়নেতা চট্টগ্রামের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এম এ আজিজসহ যখন সভা করছি, তখন বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়েছেন অনতিবিলম্বে আমি যেন ভোলা চলে যাই। বক্তৃতা শেষ করে প্রয়াত নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সাহেবের ভাইয়ের-যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন-গাড়িতে করে চাঁদপুর পৌঁছাই এবং ২৬ তারিখ সকালে গ্রামের বাড়ি পৌঁছি। ততক্ষণে বাবার দাফন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন এটা জানাননি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা আর নেই। বাবার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১৭ এপ্রিল।
প্রতিমাসে ভোলা গিয়ে গণসংযোগ ও নির্বাচনী জনসভা করি। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ নির্বাচন যখন ঘনায়মান তার ২৫ দিন আগে ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ল-ভ- হয় দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। আমি তখন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত। ১২ নভেম্বরের তিন-চার দিন আগ থেকে বিভিন্ন স্থানে জনসভা করেছি। ১০ তারিখ আমার জনসভা ছিল তজুমুদ্দী। তখন তজুমুদ্দী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন টুনু চৌধুরী। জনসভা শেষে টুনু চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা-বর্তমানে তজুমুদ্দীর উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন দুলালের বাড়িতে রাত কাটাই এবং ১১ তারিখ লালমোহনে মঙ্গল শিকদারে জনসভা করতে যাই। সেখানে জনসভায় যখন বক্তৃতা করছি তখন শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি এবং প্রচ- ঝড়। জনসভা শেষে প্রবীণ নেতৃবৃন্দসহ জিপে ভোলায় ফিরে আসি। ১২ তারিখ জনসভা ছিল তজুমুদ্দীর দাসের হাট। যখন শাহজাদা ভাইয়ের জিপে করে দৌলত খাঁ হয়ে তখন দৌলত খাঁ হয়ে তজুমুদ্দী যাওয়া যেত, রওনা করেছি তখন দৌলত খাঁ যাওয়ার পথে প্রচ- ঝড় শুরু হয়। সবাই জনসভায় যেতে নিষেধ করল। কিন্তু আমি তো রিকশা করে মাইক পাঠিয়েছি। আমার লোক চলে গেছে দাসের হাটে। সংবাদ পেয়ে আমার শ্রদ্ধেয়া মা যিনি আমার জীবনের প্রেরণার উৎস নিষেধ করলেন আমি যেন জনসভা বাতিল করি। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। মধ্য রাতে শুরু হয় তুমুল ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস। সকাল বেলা নদীর পাড়ে গিয়ে অবাক হলাম। শুধু কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ। অসংখ্য লোকের মৃতদেহ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আমরা দিশাহারা হয়ে গেলাম। স্মৃতির পাতায় আজো ভাসে শিবপুর ইউনিয়নে রতনপুর বাজারের পুকুর পাড়ে শত শত লোককে দাফন করার সেই করুণ দৃশ্য! এত মৃতদেহ দাফন করে কুলাতে পারছি না। চারদিকে মানুষের হাহাকার আর ক্রন্দন। শিবপুর ইউনিয়নে একটা বাড়ি যেখানে ৯০ জনের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র তিনজন। যখন তজুমুদ্দীর খবর পাই তখন শুনি ৪০% লোকের মৃত্যু হয়েছে। যে দাসের হাটে জনসভা করার কথা ছিল সেখানে কিছুই নেই। আমার মাইক বহনকারী মৃত্যুবরণ করেছেন। দাসের হাটে বড় বড় ব্যবসায়ী সবাই সর্বস্বান্ত। চিত্তবাবু নামে এক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি একেবারে রিক্ত। দাসের হাট, তজুমুদ্দী গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অবাক হলাম।
বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচনী গণসংযোগে সাতক্ষীরায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে লোক মারফত পাঁচ হাজার টাকাসহ বার্তা পাঠালেন, আমি যেন সর্বত্র দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং শুকনা খাবার বিশেষ করে চিঁড়া-মুড়ি ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছে দেই। আমার শ্বশুরের গদিঘরে টেলিফোন ছিল। বঙ্গবন্ধু নম্বর সংগ্রহ করে আমাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলেন, “তুই দুর্গত এলাকার প্রত্যেকটা জায়গায় ক্যাম্প কর এবং লিখে রাখ ‘আর্তের সেবায় আওয়ামী লীগ’। অনেক মানুষ রিলিফ নিয়ে যাবে কিন্তু এই দুর্গত অবস্থায় তারা মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছাতে পারবে না। কিছুটা বিলি করে বাকিটা তোর কাছে দিয়ে আসবি। তুই সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিবি।” হয়েছেও তাই। ১২ তারিখের পর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পানি, শুকনো খাবার, কেরোসিন তেল পৌঁছে দিয়েছি। হাবিবুর রহমান তালুকদার নামে একজন পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষ ছিলেন। তাঁর একটি লঞ্চ ছিল। সেই লঞ্চে নদীর পাড়ে পাড়ে মানুষের সেবা করেছি। যখন রাস্তা দিয়ে যেতাম হাট-বাজার ভেঙে মানুষ ছুটে আসত। সন্ধ্যাবেলায় এমন হতো যে, মানুষ আমার মুখের ওপর হারিকেন ধরত একনজর দেখার জন্য। মানুষজন বলত, ‘ছেলেটাকে একনজর দেখি’। ভোলার আঞ্চলিক ভাষায় বলত, ‘ছ্যামরাকে দেখি। ছ্যামরাকে দেখলে ছওয়াব হবে। আমাদের জন্য ও এত কাজ করে।’ মানুষের জন্য কাজ করলে মানুষ তার যে প্রতিদান দেয় সে দিন তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। ১৪ তারিখ বঙ্গবন্ধু ভোলায় এসে আমার শ্বশুরালয়ে উঠলেন। সেখান থেকে হাবিবুর রহমান তালুকদারের লঞ্চে করে বঙ্গবন্ধুকে আমরা দুর্গত এলাকায় নিয়ে গেলাম। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, লাখো মানুষের মৃতদেহ আর সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। যখন মনপুরায় গেলাম দেখি, বহু লোকের ভিড়ে একজন সম£ান্ত মানুষ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে। পরনে স্রেফ একটা লুঙ্গি। লঞ্চ থেকে নেমেই তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি প্রিয় শাহজাদা ভাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে টেনে আদর করলেন। লঞ্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট ছিল সেগুলো তিনি শাহজাদা ভাইকে দিলেন। ফেরার সময় নদীর পাড়ে লাখ লাখ লোকের মৃতদেহ দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আর আমার পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভবপর নয়! আমাকে তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠিয়ে দাও।’ যে বিশেষ লঞ্চে বঙ্গবন্ধু ভোলা গিয়েছিলেন সেই লঞ্চে ঢাকা ফিরে এলেন।
উপকূলীয় দুর্গত এলাকা ভোলা, রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। এভাবে আমরা মানুষকে মরতে দিতে পারি না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এখনো দুর্গত এলাকায় আসেন নাই। আমরা যে কত অসহায় এই একটা সাইক্লোন তা প্রমাণ করেছে। আরও একবার প্রমাণিত হলো যে, বাংলার মানুষ কত অসহায়! একবার পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। আরেকবার এই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রমাণিত হলো। সুতরাং আমরা এইভাবে আর জীবন দিতে চাই না। আমরা স্বাধিকারের জন্য, আমাদের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করতে চাই।’ আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করব। এই নির্বাচন হবে আমার জন্য একটা গণভোট। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে কে বাংলাদেশের নেতা এবং কিভাবে এই অঞ্চল পরিচালিত হবে।’ ভোলাসহ উপকূলীয় দুর্গত এলাকা সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করে বাংলার মানুষকে তিনি এক কাতারে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি তখন আর্তের সেবায় উদয়াস্ত কাজ করছি। ভোলাসহ দুর্গত এলাকার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রতিনিয়ত আমার খোঁজ নিতেন। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এলেন ভোলায়। তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে গাড়িতে তুলে নিলেন। ১৪ দিন পর অর্থাৎ ২৬ নভেম্বর ভোলায় এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। নামলেন চকিঘাটে। চকিঘাটে গেলাম। চকিঘাট থেকে তিনি দৌলত খাঁ গেলেন। চারদিকে হাজার হাজার লোক। প্রেসিডেন্টের গাড়িতে ছিলেন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ও গভর্নর এডমিরাল আহসান। সাহেবজাদা ইয়াকুব আমাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বললেন, হি ইজ মিস্টার তোফায়েল আহমেদ। জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন, হু ইজ তোফায়েল? স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল! তিনি বললেন, ইয়েস, স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল। ইয়াহিয়া খান আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের জন্য কী করতে পারি?’ আমি বলেছিলাম, তবুও তো আপনি এসেছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দুর্গত এলাকায় এসেছেন ঘটনার ১৪ দিন পর। আপনি এখনো নদীতে ভাসমান ও রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের মৃতদেহ দেখতে পাবেন। এই হলো আমাদের বাঙালিদের অবস্থা। তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি, ‘তার পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন।’ বললাম, আমি কেন ঘোষণা দেব? আপনার কর্মকর্তারা রয়েছেন। আপনি যা দান করবেন তা তাদের বলেন ঘোষণা করতে। তখন প্রবেশনারী অফিসার সাদাত হুসাইন-যিনি পরে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হয়েছিলেন-তিনি একটি জিপের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনাদের জন্য ২৫ হাজার টাকা সাহায্য হিসেবে বরাদ্দ করেছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনসাধারণ চিৎকার দিয়ে উঠল-‘না’ ‘না’ ‘না’। আমি দুহাত তুলতেই মানুষজন শান্ত হয়ে গেল। ইয়াহিয়া খান চলে গেলেন। সেনাবাহিনী রিলিফ তৎপরতা আরম্ভ করল। তারপর ভোলায় এলেন ভোলারই কৃতিসন্তান মোকাম্মেল হক, আনিসুজ্জামান সিএসপি (পূর্ব পাকিস্তানের রিলিফ কমিশনার), সুলতানুজ্জামান খান, (খুলনার কমিশনার) বরিশাল তখন খুলনার অধীনে। আইয়ুবুর রহমান ছিলেন বরিশালের ডিসি, তিনি এলেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তের সেবা করেছি। শ্রদ্ধেয় নেতা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এক বিরাট লঞ্চভর্তি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ভোলা এসেছিলেন ত্রাণকার্যে। কিছু তিনি বিলি করতে পেরেছেন বাকিগুলো রেখে এসেছিলেন আমার কাছে। সেগুলো আমি বিলি-বণ্টন করেছি। খাবার পানি, মুড়ি, চিঁড়া, ওষুধপথ্য বিলি করেছি দুর্গত এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে। এ ছাড়াও এসেছিল কম্বল, শাড়ি কাপড়। এর সবই অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। আমার আসনসহ উপকূলীয় এলাকার জাতীয় পরিষদের ১৭টি আসনে পূর্বঘোষিত ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন স্থগিত হয়। ইতিমধ্যে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণকার্য পরিচালনার মধ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন পাই। আমার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ জানুয়ারি। তার আগে বঙ্গবন্ধু আমায় ডেকে নিয়ে আসেন। সারা বাংলাদেশ সফর করেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। একই ট্রেনে গিয়েছি। তার পাশে থেকেছি। একই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর আগে বক্তৃতা করেছি। আবার তিনি বক্তৃতা করার সময় চলে গিয়েছি আরেক জনসভায়। বঙ্গবন্ধু যখন এক জনসভা শেষ করে আরেকটিতে আসছেন তখন আমি চলে গেছি আরেকটি জনসভায়। এভাবে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। নির্বাচনের দিনও আমি বঙ্গবন্ধুর পাশে। বিদেশি সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি কতটি আসনে জয়ী হওয়ার আশা করেন?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি অবাক হবো যদি আমি দুটি আসনে হারি।’ সত্যি দুটি আসনেই আমরা হেরেছিলাম। জাতীয় পরিষদে সরাসরি নির্বাচনে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম।
’৭১-এর ৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে শপথ অনুষ্ঠান হয় সেখানে আমিও শপথ গ্রহণ করি। যদিও তখনো নির্বাচিত হইনি। নির্বাচনী ফল ঘোষণার পর জানলাম ৭২ হাজার ভোট পেয়েছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ৬ হাজার ভোট। মাত্র ২৭ বছর ১ মাস ১৫ দিন বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই। তজুমুদ্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসার নামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেই। এরপর ঢাকা ফিরে আসি। এর মধ্যে কয়েকবার গভর্নর আহসান ভোলা গিয়েছেন। বঙ্গমাতার নামে যে স্কুল করার পরিকল্পনা করেছিলাম উনি সেখানে ৬ হাজার টাকা দান করেছিলেন। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর সেই স্কুলটি সরকারি হয়েছে। ভোলা শহরে বঙ্গমাতার নামে স্বাধীনতার পর একটি কলেজ করেছি। কলেজটির নাম ফজিলাতুন্নেসা মহিলা কলেজ। যেটায় এখন অনার্স, এমএ সবই আছে। সেটিও সরকারি হয়েছে।
স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম যান ভোলা। ’৭০-এ তিনি দেখে এসেছিলেন জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত ভোলা। ১৪ ফুট জলোচ্ছ্বাসে সবই ভেসে গিয়েছিল। যে জায়গায় বেড়িবাঁধ ছিল না, সেই স্থানকে জিরো পয়েন্ট বলতাম। সেখান দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করেছে এবং নিমেষের মধ্যে সব তলিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ছোট্ট একটি হেলিকপ্টারে করে ভোলা এসেছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। ভোলায় সেই জিরো পয়েন্টে বঙ্গবন্ধু মাটি কেটে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। ভোলা থেকে রামগতি গিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্বোধন করেছেন। আজকে বেড়িবাঁধ দিয়ে আমরা জলোচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করি, ঘূর্ণিঝড় হলে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় গ্রহণ করি। আগে এই সাইক্লোন শেল্টারকে বলা হতো ‘মুজিব কেল্লা’। এটা বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু চর কুকরী-মুকরী গেছেন, সাইক্লোন শেল্টার করেছেন, জনসাধারণকে ডিপ টিউবওয়েল দিয়েছেন, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন করেছেন। যেটা আজ ফরেস্ট হয়েছে। এসব বঙ্গবন্ধুর অবদান। বঙ্গবন্ধু ভোলাকে খুব পছন্দ করতেন। মনপুরায় তিনি ‘চিন্তানিবাস’ নামে একটি আবাসস্থল করতে চেয়েছিলেন। তার কাজও শুরু হয়েছিল। বসরতউল্লাহ সাহেব একটি দিঘি কেটে মাটি ভরাট করে কাজটি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন যুগোশ্লাভিয়া সফরে গিয়েছিলাম তখন দেখেছি মার্শাল টিটো একটা দ্বীপে থাকতেন। দ্বীপটার নাম ছিল ‘বিরুনী’। ওখান থেকে বঙ্গবন্ধু মনে করলেন ভোলার একটি দ্বীপে এরকম আবাসস্থল করবেন। যেখানে বিদেশিরা গেলে তাদের সঙ্গে মিটিং হবে। তিনি এটা করে যেতে পারেননি। মনপুরায় অবকাশ যাপনকেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। আলী মিয়া মাস্টার ছিলেন মনপুরার চেয়ারম্যান। তিনি আমার প্রিয় মানুষ ছিলেন। তার পরিবারে ২৭ জন সদস্য ছিল। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পর তিনি একাই বেঁচে ছিলেন। কত প্রিয় মুখ আমি হারিয়েছি। যার সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছে পরদিন তাকে পাইনি। ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রামগতি, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পোস্টার হয়েছিল সোনার বাংলা শ্মশান কেন? এই পোস্টারে ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের কথাই ব্যক্ত হয়েছিল। দুটো ঘটনা বাংলার মানুষকে পথ দেখিয়েছে। এক, ’৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ। যখন আমরা ছিলাম ‘অরক্ষিত’; আর ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস। যখন আমরা ছিলাম ‘অসহায়’। বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা। সেই দায়িত্বটা এখন বর্তেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্কন্ধে। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করত, ঘরবাড়ি হারাত। সেসব এখন আর নেই। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসনীয়। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার যে ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা এখন সারা বিশ্বের জন্য মডেল। বাংলাদেশে এখনো প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি আগে হতো, এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়-ক্ষতি হয় না। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলার স্বাধীনতার সফলতা।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        