তৃতীয়বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা ব্যানার্জি। গতকাল সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে রাজ্যের রাজভবনের থ্রোন হলে শপথ নেন তিনি। শপথবাক্য পাঠ করান রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। গতকাল একাই শপথ নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। আজ বৃহস্পতিবার ও কাল বিধানসভায় শপথ নেবেন সদ্য বিজয়ী বিধায়করা।
করোনা সংক্রমণের কারণে অনাড়ম্বর ও সংক্ষিপ্ত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন মাত্র ৫০ জন। অতিথিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মমতার ভাতিজা তথা তৃণমূল সংসদ সদস্য অভিষেক ব্যানার্জি, তৃণমূলের ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে), তৃণমূল সংসদ সদস্য সুদীপ ব্যানার্জি, সৌগত রায়, দীপক অধিকারী (দেব), শতাব্দী রায়, সুব্রত বক্সি, সদ্য জয়ী বিধায়ক সুব্রত মুখার্জি, পার্থ চ্যাটার্জি, ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, বিমান ব্যানার্জি। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেস সংসদ সদস্য প্রদীপ ভট্টাচার্য, মুখ্যসচিব আলাপন ব্যানার্জি, স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ কে দ্বিবেদীসহ সরকারের শীর্ষস্তরের কর্মকর্তারা। তবে রাজ্যজুড়ে ভোট-পরবর্তী সহিংসতার অভিযোগ তুলে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন না বিজেপির কোনো প্রতিনিধি। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতার শপথ গ্রহণের পরই ট্যুইট করে তাকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে আধাঘণ্টারও কম সময় ধরে চলে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথগ্রহণ শেষে উপস্থিত সবার সঙ্গে সৌজন্যবিনিময় করেন রাজ্যপাল। এরপর মমতা ব্যানার্জি, প্রশান্ত কিশোর, অভিষেক ব্যানার্জি, দেবকে পাশে নিয়ে ফটোসেশনে যোগ দেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণের পর রাজভবনে একটি চা-চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। তা সেরে তিনি রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নে পৌঁছেন। মমতা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো করোনাকে মোকাবিলা করা। সবাইকে আমি আমন্ত্রণ জানাতে পারিনি। কভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনেই রাজ্যপাল ও আমার অতিথি নিয়ে মাত্র ৫০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাই দয়া করে কেউ কিছু মনে করবেন না। আমায় ক্ষমা করে দেবেন। করোনার সময়কালে আপনারা সবাই অনেক কাজ করেছেন। তাই আপনাদের সবাইকেই আমন্ত্রণ করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি করতে পারিনি। তবে করোনা শেষ হলে আমরা ব্রিগেড ময়দানে বিজয় উৎসব করব, তখন সবাইকে এমনকি বাইরের অতিথিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে।’গত রবিবার রাজ্য বিধানসভার গণনার পর রাত থেকেই রাজ্যজুড়ে যে সহিংসতা চলে আসছে তা নিয়েও এদিন মুখ খোলেন মমতা ব্যানার্জি। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরই সব রাজনৈতিক দলকে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়ার কথাও বলেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি বলেন, ‘কভিড মোকাবিলার পর আমার দ্বিতীয় কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ঠিক করা। আমি সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন করব সবাই শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। বাংলা কোনো অশান্তি পছন্দ করে না। আমি নিজেও করি না। কোথাও যাতে কোনো সহিংসতা না হয়।’ হিংসা ছড়াতে তার বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে কথাও জানিয়ে দেন মমতা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়..., আমি আজ থেকেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দায়িত্ব নিচ্ছি এবং কঠোর হাতে এর মোকাবিলা করব। যদি কেউ অশান্তি করে তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে পিছ-পা হব না। কারণ আমি শান্তির পক্ষে।’
অন্যদিকে শপথগ্রহণের পর মমতাকে ‘বোন’ সম্বোধন করে অভিনন্দন জানান রাজ্যপাল। এরপরই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। রাজ্যপাল বলেন, ‘আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করা। আশা করি মুখ্যমন্ত্রী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেবেন।’ শপথ গ্রহণের পরই মমতা চলে যান রাজ্য সরকারের সচিবালয় ‘নবান্নে’। সেখানেই পুলিশের তরফ থেকে মমতাকে দেওয়া হয় ‘গার্ড অব অনার’। মমতা যখন রাজভবনে শপথ নিচ্ছেন ঠিক তখনই ভোট-পরবর্তী সহিংসতার প্রতিবাদে কলকাতার হেস্টিংসের দলীয় কার্যালয়ের সামনে ধরনায় বসেন বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা, রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষসহ অন্যরা। পরে ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েই বিজেপির সদ্য বিজয়ী বিধায়করা শপথ গ্রহণও করেন। তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান দিলীপ ঘোষ। আর ঠিক এই ইস্যুতেই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানও বয়কট করে বিজেপি।
ভোট-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি বিজেপিতে যোগ দেওয়া অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীও। মিঠুন লেখেন, ‘ভোটের পরও বাংলায় হিংসার আগুন জ্বলছে। দয়া করে এই সহিংসতা বন্ধ করুন। মানুষের জীবন রাজনীতির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্র্ণ। তাদের পরিবারের কথা ভেবে এই সহিংসতা বন্ধ করুন।’
শপথ নিয়েই করোনা রুখতে কড়া পদক্ষেপ মমতার : করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে আজ বৃহস্পতিবার থেকে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সব লোকাল ট্রেন পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। এ ছাড়া মেট্রো ও সরকারি বাসের সংখ্যাও ৫০ শতাংশ কমানো হবে। গতকাল নতুন এই সিদ্ধান্তের কথা জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে এদিনই একাধিক পদক্ষেপ নেন মমতা ব্যানার্জি।
গতকাল রাজ্যের মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, স্বাস্থ্য সচিবসহ রাজ্য পুলিশের ডিজি, কলকাতার পুলিশ কমিশনারসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ওই বৈঠকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগ দেন প্রতিটি জেলার জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও মুখ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। বৈঠক শেষ করেই সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের তরফে নেওয়া একগুচ্ছ নির্দেশিকা ঘোষণা করেন মমতা। এদিন মূলত দুটি বৈঠক করেন মমতা- এর একটি করোনা সম্পর্কিত অন্যটি ভোট-পরবর্তী সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে।
বৃহস্পতিবার থেকেই রাজ্যের সব শপিং মল, বিউটি পারলার সিনেমা হল, রেস্তোরাঁ, বার, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, জিম, স্পা, সুইমিং পুলও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া রাজ্যে সব ধরনের রাজনৈতিক সমাবেশ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, বিনোদনমূলক জমায়েতও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিবাহ অনুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত আকারে করার কথা বলা হয়েছে। তবে সেখানে কোনোমতেই ৫০ জনের বেশি মানুষের জমায়েত থাকবে না।
