সোমবার, ৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বিএনপি জোটের বেহাল দশা

অবমূল্যায়ন অবমাননায় ক্ষোভে ফুঁসছে শরিক দলগুলো । জমিয়তের পর ছাড়ার চিন্তা আরও অনেকেরই । জোট নিয়ে এখন চিন্তাভাবনা নেই, দল নিয়ে কাজ করছি : বিএনপি মহাসচিব

শফিউল আলম দোলন

বিএনপি জোটের বেহাল দশা

বেহাল অবস্থা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের। কোনো কার্যক্রম নেই। রাজনীতির মাঠে কোথাও কোনো কর্মসূচি নেই। নামেমাত্র অস্তিত্বটুকু ধরে রেখেছে দেশের বৃহৎ এই বিরোধীদলীয় জোট। প্রধান দল বিএনপির অবমূল্যায়ন, অবহেলা ও অবমাননায় ক্ষোভে ফুঁসছে শরিক দলগুলো। বিএনপির ‘একলা চলো নীতি’-তে আগ্রহ ও উৎসাহ হারাচ্ছে শরিকরা। সৃষ্টি হয়েছে চরম হতাশা। যোগাযোগই বন্ধ করে দিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। সবচেয়ে বেশি তুঙ্গে জামায়াত-বিএনপির টানাপোড়েন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জোট নিয়ে এখন আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। এমনকি স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা এখন দল নিয়ে কাজ করছি। নিজেদের দল গোছাচ্ছি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বছরে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দু-একটি বৈঠক ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই এই জোটের। তা-ও গত দুই বছরে কোনো বৈঠকে জোটের শীর্ষ বা মহাসচিব পর্যায়ের কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান মাঝেমধ্যে তাদের নিয়ে একটু আধটু চা-চক্রের আয়োজন করেন। এর মধ্যেই কিছুদিন আগে জোট ছেড়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশ। তারও আগে বিদায় নিয়েছে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমানের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। ইসলামী ঐক্যজোট, বিকল্প ধারা, এনপিপিসহ আরও কয়েকটি সংগঠন এর আগে ২০ দল ছেড়ে গেলেও একই নামে খন্ডিত বা আংশিকভাবে সংগঠনগুলো নামেমাত্র ধরে রাখা হয়েছে এই জোটে। তাছাড়া জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রাখা না রাখা নিয়েও চলছে ব্যাপক টানাপোড়েন। নেতৃত্বাধীন দল বিএনপি একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে শরিক দলগুলোকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে চলছে।

জোটের অন্যতম শরিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জোটের এখন কোনো কর্মকান্ড নেই। তাই আমরা আমাদের নিজ নিজ দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলো গোছানোর কাজ করছি। তাছাড়া করোনার সময় চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সরকারিভাবেও রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে ২০-দলীয় জোট। এর মধ্যে নিবন্ধিত দল মাত্র ছয়টি, বাকি দলগুলো অনিবন্ধিত। অধিকাংশ দল চলছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনেও অংশ নেয়নি তারা। মতবিরোধের কারণে বিএনপির প্রার্থীদের সঙ্গেও ভোটের মাঠে ছিলেন না শরিক দলের নেতারা। আন্দোলন-সংগ্রামেও রাজপথে এখন আর

 তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এর মধ্যেও জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (আংশিক), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জাতীয় পার্টিসহ (কাজী জাফর) হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করছে। বাকি শরিক দলগুলোর কোনো তৎপরতাই নেই। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জোটের ঐক্য নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই। করোনা মহামারীর কারণে এখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি শরিক দলগুলোর একে অপরের মধ্যে যোগাযোগটাও তেমনভাবে হচ্ছে না। ফলে জোটের কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ রয়েছে। জানা গেছে, জোটের অধিকাংশ শরিক সংগঠনের ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত নেই। কারও কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও জেলা বা উপজেলা কমিটির কোনো বালাই নেই। তাদের মাঝেও আবার ‘ওয়ান ম্যান- ওয়ান পার্টি’ হিসেবেও পরিচিত কয়েকটি। ফলে এসব সংগঠন নিয়েও বিএনপির মধ্যে জোট নিয়ে একটা অনাগ্রহ কাজ করছে। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমি মনে করি, চালকের আসনে থাকা বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা সঠিক ভূমিকা পালন করলে সরকারের পতন যে কোনো সময় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জোটের ভিতরে বেশ কিছু দল আছে, যাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল, নেতৃত্বের অবস্থা খুবই খারাপ। এখন বিএনপি তাদের কেন নিয়েছে এবং কেনই বা রাখছে সে ব্যাপারে বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে সর্বশেষ ২০-দলীয় জোটের একবার ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। বিএনপি এই জোটের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী দল। তাদেরই জোট চাঙা করার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা জোটগত রাজনীতি চালু রাখার ক্ষেত্রেও বিএনপিকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

বিএনপি-জামায়াত টানাপোড়েন : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব, দলের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাহিদাসহ নানা কারণে জামায়াতে ইসলামীকে ত্যাগ করার যে প্রস্তাব বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উঠেছিল, তা নিয়ে চলছে দুই দলের মধ্যে চরম টানাপোড়েন। সে ব্যাপারে সুপারিশ বা প্রস্তাব তৈরির জন্য স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি একটি প্রতিবেদন পেশ করলেও সেই প্রতিবেদনে জামায়াতের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক না রাখার প্রস্তাব করে তার পক্ষে কারণ এবং যুক্তিও তুলে ধরা হয়। সেটি এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা আলোচনায় স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই জামায়াতের সঙ্গে দলের জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে মত দিয়েছেন। ফলে ২০-দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী এখন কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য শরিক দলেও রয়েছে ক্ষোভ এবং হতাশা। অন্যদিকে, জোটের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই জানিয়ে বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি জানান, নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে একমত পোষণ করে সবাই জোটে সম্পৃক্ত হয়েছি। কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক বিস্তৃতি এক নয়। তাই যে যার মতো করেই আন্দোলনকে একটি চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের মতো এসব দলের অনেক নেতা-কর্মীকে মামলা-হামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড আর কারাবরণ করতে হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর