রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দোকানে দোকানে ভেজাল ওষুধ। রোগ সারানোর জন্য ওষুধ খেয়ে উল্টো মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন অসহায় মানুষজন। জন্মনিরোধক ওষুধ খেয়েও প্রেগন্যান্সিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন অনেক ছাত্রী, গৃহবধূ ও কর্মজীবী নারী। ভেজাল ওষুধ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। তবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৫০টি ইউনানী, হারবাল, আয়ুর্বেদিক ওষুধ কারখানায় জীবন রক্ষাকারী ভেজাল অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরি হচ্ছে এমন তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এরই মধ্যে কেবল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগ পিরোজপুর, কুমিল্লা ও ফেনীতে অভিযান চালিয়ে আদালতের মাধ্যমে ছয়টি কারখানা বন্ধ করেছে। তবু সক্রিয় ভেজাল চক্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল ওষুধ বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও নজরদারির ঘাটতির কারণেই ভেজাল চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করে মুখোশ উন্মোচন করা উচিত। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে তা চলতেই থাকবে। ভয়াবহ হুমকিতে পড়বে জনজীবন। ভেজাল ওষুধের সঙ্গে খাদ্যে ভেজালের বিষয়েও ‘জিরো টলারেন্স’ প্রদর্শনের পরামর্শ তাদের। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করছি। চলতি বছরই ১৭০০ মামলা করা হয়েছে। ৪৯ জনকে জেলে পাঠানো হয়েছে। ৬৬টি কারখানার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। র্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আমরা চাই সাধারণ মানুষও আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করুক।’ শনিবার রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় ওষুধ প্রশাসনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বাবুবাজার সুরেশ্বরী মেডিসিন প্লাজার নিচতলার মেডিসিন ওয়ার্ল্ড ও অলোকনাথ ড্রাগ হাউস এবং পার্শ্ববর্তী হাজী রানী মেডিসিন মার্কেটের নিচতলায় রাফসান ফার্মেসি থেকে বিপুল পরিমাণ নকল আই-পিল, সুপার গোল্ড কস্তুরি, ন্যাপ্রোক্সিন প্লাস-৫০০+২০০ এমজি, বেটনোভেট-সি ২০ এমজি, প্রটোবিট-২০ এমজি, ইনো সানাগ্রা-১০০, পেরিয়েকটিন, মুভ, রিংগার্ড, হুইটফিল্ড, নিক্স রাবিং বাম, ভিক্স কোল্ড প্লাস, ভিকস ও গ্যাকোজিমা উদ্ধার করে। গ্রেফতার করে ফয়সাল আহমেদ, সুমন চন্দ্র মল্লিক ও মো. লিটন গাজী নামের তিনজনকে। এর আগে ১২ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কোতোয়ালি জোনাল টিম রাজধানী ঢাকা, সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ বিসিক শিল্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ জব্দ করে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় আটজনকে, যারা রীতিমতো কারখানা বানিয়ে নামি-দামি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন নকল ওষুধ তৈরি করত। তাদের কারখানা থেকে নকল ওষুধ তৈরির ডায়াস ও মেশিন উদ্ধার করা হয়েছে। এর কিছুদিন আগে ডিবির গুলশান বিভাগ ২৯ জুন রাজধানীর হাতিরপুল, রামপুরা, মালিবাগ ও নারায়ণগঞ্জের জালকুঁড়িতে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেফতার করে। এরা ইচ্ছামতো জেনেরিক নেইম/ট্রেড নেইম দিয়ে ওষুধগুলো চালিয়ে দিচ্ছিল। একেক সময় তা হয়ে উঠছিল হার্টের ওষুধ, কখনোবা লিভারের, আবার কখনো হাড় ক্ষয়ের। ডিবির যুগ্ম-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘মিটফোর্ড এলাকা থেকে যারা সারা দেশে নকল ওষুধ পাঠাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে এবং সামনের দিনগুলোতেও অভিযান চলমান থাকবে। ইউনানী লাইসেন্স নিয়ে নকল ও অবৈধ ওষুধ তৈরি করছে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো অনেক সময় বন্ধ থাকে। রাতের আঁধারে কারখানা খুলে কার্যক্রম চালায়। পরে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এ ওষুধ তারা সারা দেশে পাঠিয়ে দেয়।
ইউনানী ও হোমিওপ্যাথির লাইসেন্স নিয়ে যারা অবৈধ ওষুধ তৈরি করছে তাদের তালিকা ডিবি তৈরি করেছে। সরবরাহকারী বা উৎপাদনকারী সবাইকে আমরা তালিকাবদ্ধ করছি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, দৃষ্টান্তমূলক সাজা না দিলে ভেজাল চক্রকে থামানো যাবে না। ভেজাল ওষুধের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। মানুষের রোগ তো ভালো হয়ই না, অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে জটিলতা তৈরি হয়। আবার নকল ওষুধ যদি ক্ষতিকারক কিছু দিয়ে বানায় তবে তা মানবদেহের জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণনের জন্য রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে একাধিক চক্র কাজ করছে। অনেকে নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। কেউ কেউ আয়ুর্বেদিক লাইসেন্সের আড়ালে কারখানা বানিয়ে, আবার কেউ ফ্ল্যাট বাসায় ডায়াস বসিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করে। মাঝেমধ্যেই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে একেকটি চক্রকে আইনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু তারা আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে এসে ঠিকানা পরিবর্তন করে আবারও একই কাজ করে থাকে। গত কয়েক বছরে মিটফোর্ডের ওষুধের বাজার থেকেই কোটি কোটি টাকার নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ করা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় কারখানা স্থাপন করলেও এসব ওষুধ বিক্রির কেন্দ্রস্থল হলো পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকা। এখানে গড়ে ওঠা ওষুধের পাইকারি বাজার থেকেই মূলত সারা দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ে। করোনা মহামারীতে বহুল ব্যবহৃত একমি ল্যাবরেটরিজের মোনাস-১০ এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মনটেয়ার-১০ (জেনেরিক নাম মন্টিলুকাস্ট) নকল উৎপাদন ছাড়াও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেফ-৩ (জেনেরিক নাম সেফিক্সিম-২০০মিলিগ্রাম), সেকলো-২০ (জেনেরিক নাম ওমিপ্রাজল বিপি ২০ মিলিগ্রাম), জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালসের ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস-৫০০ উৎপাদন করত। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি তারা যেসব নকল ওষুধ জব্দ করেছেন। এর মধ্যে সেফ-৩-এর বাজারমূল্য প্রতি পিস ৩৫ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ নকল সেফ-৩ বিক্রি করা হয় প্রতি পিস ৫ টাকা করে। একইভাবে ছয় টাকা মূল্যের সেকলো ১টা ৭৫ পয়সা, ১৬ টাকা মূল্যের মনটেয়ার ৩ টাকায়, ১১ টাকা মূল্যের ন্যাপ্রোক্সেন আড়াই টাকায় এবং ১৬ টাকা মূল্যের মোনাস ৩ টাকায় বিক্রি করা হতো। ফার্মেসি মালিকরা অধিক লাভের আসায় আসল ওষুধের নামে নকল ওষুধ বিক্রি করতেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ‘আমাদের পরামর্শ হলো, কোনো ওষুধের প্যাকেটে রংয়ের তারতাম্য, ওষুধের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ হলে ওই ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনবেন না। জনগণকে অবশ্যই ইনভয়েস নম্বর দেখে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হবে। ইনভয়েস নম্বর হলো ওষুধের সার্টিফিকেট। যে কোম্পানি থেকে ওষুধ ক্রয় করা হয় সে কোম্পানির ইনভয়েস ওষুধ ফার্মেসিকে সংরক্ষণ করতে হয়। তবে অনেক নামসর্বস্ব ফার্মাসিউটিক্যালস, হারবাল, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক কারখানায় তৈরি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ।