বুধবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ব্যর্থতার সঙ্গে সফলতাও আছে : শাহাদাত চৌধুরী

ব্যর্থতার সঙ্গে সফলতাও আছে : শাহাদাত চৌধুরী

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর কেমন কাটল?

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরে মিক্স ফিলিংস রয়েছে। অনেক ভালো আছে, অনেক খারাপ আছে। এর মধ্যে সাফল্য আছে, ব্যর্থতা আছে। ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সবকিছু মিলে  ইসিতে পাঁচ বছর কেটেছে। ভালো লাগাটা হচ্ছে- আমি সৌভাগ্যবান যে ইসির মতো একটি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়েছে। মিশ্র ফিলিংস হচ্ছে- যেসব জায়গায় ব্যর্থতা ছিল, ভুলত্রুটি ছিল তা যদি না হতো আরও ভালো লাগত।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সাফল্য-ব্যর্থতা কী কী?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : আমরা চেষ্টা করেছি নির্বাচনগুলো আইন অনুযায়ী করার। ইসির যেসব দায়িত্ব তা আমরা সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছি। ইউপি নির্বাচনও ভালো হয়েছে। আমি বলব না এটা খারাপ হয়েছে। কিছু সহিংসতা হয়েছে। সে দুর্নাম আমাদের নিতে হয়েছে। আমরা এ নির্বাচনকে কন্ট্রোল করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বাড়িয়ে দিয়েছি। আমি মনে করি এটা একটা সামাজিক সমস্যা। আসলে এখন যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তারা মনে করেন, যে কোনোভাবেই নির্বাচিত হতে হবে। কিন্তু পরাজিত হলে তারা ফলাফল মনে নিতে চান না। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, কিছু সংসদ সদস্যের প্রভাবে ইউপি নির্বাচনের কিছু প্রার্থী এবং তাদের অতি উৎসাহী কর্মী-সমর্থকরা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক সহিংসতা বাড়িয়েছে কি না?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : এটা একটা গবেষণার বিষয়। দলীয় প্রতীক থাকলেও কিছু কিছু উপজেলায় ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীক ছাড়াই হয়েছে। আমার মনে হয় সেসব জায়গায় সহিংসতা কম হয়েছে। দলীয় প্রতীক থাকলে যেটা হয়- স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যারা আছেন, সংসদ সদস্য আছেন তারা কারও না কারও পক্ষে-বিপক্ষে থাকেন। তখন তারা তাদের প্রভাব বিস্তার করেন। পেশিশক্তি বা মানি পাওয়ার তারা ব্যবহার করেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবারে প্রাণহানি কম হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রাণহানিবিহীন নির্বাচন করতে হলে কী করা দরকার?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : এটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাবতে হবে। একটা রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন স্থানীয় পর্যায়ে অনেক নেতা-উপনেতা তৈরি হয়। সেখানে তারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। আবার সেখানে স্থানীয় যারা এমপি আছেন তারা যদি যোগ হন তখন সেটা আরও গতি পায়। অন্যদিকে ইউপি নির্বাচনে পূর্বশত্রুতার জেরেও সহিংসতা হয়। তবে সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : পাঁচ বছরে নির্বাচন নিয়ে বড় কোনো সংকট হয়েছিল কি?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : নির্বাচন কমিশন হলো একটা রিফারি। এখানে খেলার জন্য প্লেয়ারদের আসতে হবে। এজন্য প্লেয়ারদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রয়োজন আছে। আর প্লেয়াররা যদি তাদের শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে না আসেন তবে সেখানে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়, এটা আমি মনে করি। এ রকম একটি বড় সংকট আমরা ফেস করেছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : পাঁচ বছরে কোনো হতাশা আছে কি? পাঁচ বছরের কমিশনের টিমওয়ার্ক কেমন ছিল।

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন কমিশন এসেছে, যত নির্বাচন হয়েছে প্রতিটি নির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হয়েছে। প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনকে কিছু না কিছু দুর্নাম নিয়ে যেতে হয়েছে। যারা নির্বাচন কমিশনে আসেন তারা কর্মজীবনে অনেক অর্জনের পর এখানে আসেন। কিন্তু এখানে এসে তাদের সুনামের কিছুটা বিসর্জন দিতে হয়েছে। আমি হতাশা বলব না। ইসিতে আসার পর আমার বোধোদয় হয়েছে। প্রথমত, আপনি যত ভালো কাজই করুন না কেন কিছু না কিছু দুর্নাম আপনাকে নিয়েই যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, পাঁচজনের এ কমিশন একক সত্তা হিসেবে কাজ করে। এখানে যিনি সভাপতিরূপে কাজ করেন তার ব্যক্তিত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু চ্যালেঞ্জ-প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিছু কিছু আইনি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি ইসি সচিবালয় আইনে কিছুটা সংস্কার করা উচিত। তাহলে কমিশন একটা টিম হিসেবে কাজ করতে পারবে। সচিবালয় হচ্ছে কমিশনের সচিবালয়। এ সচিবালয়ের ওপর কমিশনের যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তবে তো কমিশন সেভাবে পারফর্ম করতে পারবে না। কমিশন নির্বাচন নিয়ে ডিল করে। আর এ নির্বাচন করেন রিটার্নিং অফিসার তথা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। আর এ কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন কমিশন কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে না। যদিও আমি মনে করে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। সে ক্ষেত্রে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে আমরা বদলি করতে পারি না। এ ক্ষেত্রে কেন তারা আমাদের কথা শুনবেন? সেখানে যদি তারা অনিয়ম করেন তবে আমরা তো তাদের আইনের আওতায় আনতে পারছি না। পাঁচ বছরের কমিশনের টিমওয়ার্ক আশানুরূপ হয়নি বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাতের বেলা ভোট হয়েছে? এ বিষয়ে কী বলবেন?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আমরা রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করেছিলাম জেলা প্রশাসকদের। আইনশৃঙ্খলার জন্য সব বাহিনীকে নিয়োজিত করেছিলাম। নির্বাচনের দিনে আমরা মিডিয়া ফলো করেছি। আমি দেখিনি কোন মিডিয়ায় এসেছে যে নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয়েছে। বিবিসি যে কেন্দ্র নিয়ে নিউজ করেছিল সেই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়েছিল। একটি কেন্দ্র দিয়ে ৪১ হাজার কেন্দ্রের কথা বলা যায় না। তার পরও যদি কেউ প্রমাণ পায়, যদি ডকুমেন্ট থাকে সেটার জন্য তো একটা নির্বাচনী আইন রয়েছে। তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। প্রায় ৬ হাজার কেন্দ্রে ৯৯ ভাগ ভোট পড়েছে।

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : আমি মনে করি শতভাগ ভোট পড়ার কথা নয়। আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যে এটা একটা। আমি মনে করি এটা তদন্ত করা উচিত ছিল।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দলীয় সরকারের আমলে নির্বাচন করতে গিয়ে চাপের মুখোমুখি হয়েছেন কি না? আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কি না?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : দলীয় সরকারের আমলে নির্বাচন করতে গিয়ে কখনো চাপের মুখোমুখি হইনি। আমাদের বাস্তবতাটা পরিবর্তন করা দরকার। সে ক্ষেত্রে আমরা যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরণ ঘটাই, দলগুলোর মধ্যে যদি গণতন্ত্রের চর্চা থাকে, একের প্রতি অন্যের আস্থার সংকট যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি এজন্য আমাদের বেশি সময় লাগছে। আরও একটু সময় লাগবে। রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে। আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। অনাস্থার সংকট আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের গণতন্ত্র পরিশালিত কওে, সেক্ষেত্রে সরকারি দল হতো আর বিরোধী দল হতো। অন্যরা পারলে আমরা কেন পারব না। আমি মনে করি গণতন্ত্র পরিশালিত হলে সুন্দর নির্বাচন সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন নিয়ে একজন নির্বাচন কমিশনার সবসময় ভিন্ন সুরে বক্তব্য দিয়েছেন। অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন। কমিশন বৈঠকে কথা বলতে দেওয়া হতো না এমন অভিযোগও করেছেন ওই নির্বাচন কমিশনার। এ বিষয়ে কী বলবেন?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : আমরা নির্বাচন কমিশনে যে পাঁচজন ব্যক্তি আছি। পাঁচজন কিন্তু আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব। প্রত্যেকেরই যার যার নিজস্ব একটা সত্তা আছে। সুতরাং উনি ওনার সত্তায় কথা বলবেন। এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি বলতে চাই- আমরা কখনো কথা বলতে বাধা দেইনি। আর বরিশাল সিটি নির্বাচনের বিষয়ে আমি বলেছিলাম একটি-দুটি কেন্দ্রে যে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, আপনি চাইলে ওই কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করতে পারেন। তখন যদি একটি-দুটি কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করা হতো, তবে অঙ্কুরেই অনিয়ম বন্ধ হতো। কিন্তু উনি নির্বাচন শেষ হওয়ার ১৫-২০ মিনিট আগে নির্বাচনটা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। নির্বাচন বন্ধে আইনগত কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নির্বাচন হওয়ার পরে যদি আমরা বলি নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে, এ জন্য পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেব। সেই ক্ষেত্রে আমাদের সবার মনে হয়েছে, নির্বাচন বন্ধ করলে তা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। হয়তো অনেক প্রাণহানি ঘটে যেতে পারত। সেই বিবেচনায় নির্বাচনটা বন্ধ করা হয়নি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ইভিএমে ভোট নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক আছে। আপনি কি মনে করেন আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট করা যায় বা করা উচিত হবে? একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট করার বিষয়ে বর্তমান কমিশন কতটুকু প্রস্তুতি রেখে যাচ্ছে?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে আগে যে রকম বিরোধ ছিল এখন সেই বিরোধ কমেছে। তবে ধীরগতি বিষয়ে যেটা বলা হচ্ছে, এক্ষেত্রে অনেকের হয়তো ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলছে না। এক্ষেত্রে দু-একজন ভোটার চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেসব নির্বাচনী অনিয়ম হয়, তা বন্ধ করার জন্য ইভিএম একটি ভালো ডিভাইস। ইভিএম নিয়ে যদি কোনো সংশয় থাকে কোনো দলের আমরা বারবার বলেছি, আপনারা আসেন আমরা বুঝিয়ে দেব। কিন্তু কেউ আসেননি। তবে ২০-দলীয় জোটের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান দুই দিন আমার কাছে এসেছিলেন। উনি বলেছিলেন- তার সংসদীয় আসনে ইভিএম দিতে।

ইভিএম নিয়ে কোনো কোনো ব্যক্তি ভুল ব্যাখ্যা করছেন। সেটা হলো ভারতের ইভিএমের সঙ্গে তুলনা করে বলা হচ্ছে আদালতের নির্দেশে ভারতের ইভিএমে Voter verified Paper Audit Trail (VVPAT) যুক্ত করেছে। আমরা কেন করিনি। তবে আমি বলব- কারিগরি দিক থেকে এই দুই ইভিএম দুই ধরনের। আমাদের ইভিএম একজন ভোটারকে কনফার্ম করলে মনিটরে পুরো ছবি দেখা যায়। আবার বলা হয়- আদালতে গেলে ইভিএম বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। এটাও সঠিক নয়। আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে ইভিএমে ভোট আবারও গণনা করা যায়। সেটার উদাহরণ হচ্ছে ঢাকার সিটি নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে ফলাফল পুনঃগণনা হয়েছে। সেখানে ফলাফলও কিন্তু চেঞ্জ হয়েছে। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট করা যাবে কি না?- সেটা আমি বলব না। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হলে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা উচিত। বর্তমানে যে পরিমাণ ইভিএম রয়েছে তা দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে ১০০ আসনে ভোট করা যাবে। তবে সে জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর নিয়ে কিছু লিখবেন কি?

শাহাদাত হোসেন চৌধুরী : আমি নিজেকে একটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করেছি। “নির্বাচন এবং বাংলাদেশের ইতিহাস” এটা আমার একটা গবেষণার বিষয়। এটার ওপরে কিছু লেখালেখি করার ইচ্ছা আছে। আমি অবসর সময়ে গলফ খেলি, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে আমি পছন্দ করি।

সর্বশেষ খবর