শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বাধার মুখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

মানিক মুনতাসির

বাধার মুখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই পুরো অর্থনীতি প্রায় তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতিতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এতে ডলারের সংকট বাড়ছে প্রতিদিনই। এ ছাড়া সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে আমদানির ব্যয় মেটানোর কৌশলও সফল হচ্ছে না। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাধার মুখে পড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই সময়ে বাজেট বরাদ্দের ১ শতাংশ অর্থও ব্যয় করতে পারেনি ১৯ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ফলে অর্থবছর শেষে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে খোদ সরকারের ভিতরেও। তাই বাজেট সংশোধনের সময় এ বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে এর আগে প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেট বাস্তবায়নের ধারা এবং অর্থনৈতিক গতিবিধিকে বিবেচনায় নেবে সরকার। অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। নতুন করে কোনো বিনিয়োগ আসছে না। করোনা মহামারিতে কাজ হারানোদের অনেকেই এখনো বেকার রয়েছেন। একই সঙ্গে নতুন করে কাজে ঢুকতে পারছেন না স্নাতক শেষ করা তরুণরা। এতে শিক্ষিত বেকারের বোঝাও বাড়ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের বাজেট বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) বরাদ্দের মাত্র ৯ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা খরচ করতে সক্ষম হয়েছে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এর আগের দুই অর্থবছরে এ হার ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছর সরকারকে এডিবি বরাদ্দ দিয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি সত্ত্বেও গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল।

এডিবি বলছে, এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। এর আগে টানা কয়েক বছর ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যেও স্থান করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ চলতি বছর শেষে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, এটা হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকও বলেছে, চলতি বছর শেষে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অবশ্য গতকাল সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অগ্রগতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে তিন খাতে সংস্কারের কথা বলছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, এসব খাতে সংস্কার না হলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি কমার পাশাপাশি ২০৩৫ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। আর মোটামুটি ধরনের সংস্কার হলে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ভালো রকম সংস্কার হলে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে আবারও রেপোর সুদ হার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হলে আগের চেয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি সুদ গুনতে হবে। গতকাল মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) ৫৬তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। একই দিন বিশ্বব্যাংক বিশ্ব অর্থনীতি ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ‘চেঞ্জ অব ফেব্রিক’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য তিনটি বাধা চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো- বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস, দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাত এবং ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত নগরায়ণ। এ তিন বাধা দূর করতে পারলে উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে এবং ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি আরও টেকসই হবে বলে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংক।

অন্যদিকে জিনিসপত্রে দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে মূল্যস্ফীতির চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যদিও মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য সরকার প্রকাশ করছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু বাজারে জিনিসপত্রের দাম এবং মানুষের জীবনধারণের অবস্থা দেখলে মূল্যস্ফীতির চাপ যে অনেক বেশি তা খুব সহজেই অনুমিত হয় বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বিবিএসের খসড়া হিসাবে গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে আর খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে উঠেছে। অবশ্য এ তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, যা চলতি মাসের প্রথম দশকেই বিবিএস থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত পরশু ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ নেমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ছে, এর পরও রিজার্ভ বাড়ছে না।

সরকারের নেওয়া কার্যকর পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ কিছুটা কমতে শুরু করেছে। আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে এ খাতের ব্যয় নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল হয়েছে সরকার। এদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাত। ডলারের বাজারেও কিছুটা নিম্নমুখিতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে খোলাবাজারে ডলারের রেট এখনো ১১২ টাকা। এটিকে আরও কমিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আমদানির লাগাম টেনে ধরায় আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নিম্নমুখিতা দেখা দিয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে আমদানি ব্যয়ের দায় পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়নে নেমে এসেছিল। আর ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা ৩৬ বিলিয়নে নেমেছে। তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ইতিবাচক ধারা এবং আমদানি ব্যয় নমনীয় হওয়া সামগ্রিকভাবে রিজার্ভের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক। তবে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় এবং জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় সব ধরনের পণ্যমূল্য বেড়েছে। এমনকি পরিবহন ও সাধারণ থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধেরও দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে জীবনযাত্রায় অস্বস্তি বাড়াচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এর চূড়ান্ত রূপ হিসেবে চোখ রাঙাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, বিদায়ী আগস্টে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এমনকি চলতি সেপ্টেম্বরেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে তিনি ধারণা প্রকাশ করেছেন। বিবিএসের তথ্যমতে, সর্বশেষ জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আগস্টের মূল্যস্ফীতি এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে খসড়া হিসাবে তা ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া আমদানির সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে হবে রপ্তানি আয়ের। দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার সমান ৯৫ টাকা ধরে) এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৮১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছরের (জুলাই) একই সময়ের চেয়ে এ বছর বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর