শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আইনি জটিলতা পিছু ছাড়ছে না জাপা চেয়ারম্যানের

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

আইনি জটিলতা পিছু ছাড়ছে না জাপা চেয়ারম্যানের

আইনি জটিলতায় আটকে আছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের। দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা থাকায় জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ৩১ অক্টোবর থেকে দলীয় কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন না। ৪ অক্টোবর জিয়াউল হক জি এম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। মামলায় দল থেকে জিয়াউল হকের বহিষ্কারাদেশকে বেআইনি ঘোষণা এবং দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০-এর উপধারা ১(১) অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানানো হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে পার্টি  চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞায় দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তারা বলছেন, জাতীয় পার্টিকে চাপে রাখার জন্য এমন সিদ্ধান্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন তা প্রমাণিত হয়েছে। জানা যায়, আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকায় ২০ দিন ধরে দলীয় কার্যক্রমেও অংশ নেননি জি এম কাদের। বনানী কার্যালয়ে মাঝেমধ্যে গেলেও দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ৬ নভেম্বর সংসদে       বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে ২০তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্য দিয়েছেন। আর ৭ নভেম্বর জি এম কাদেরের  উত্তরার বাসভবনে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

গত বুধবার ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জাপা চেয়ারম্যানের ওপর দেওয়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন খারিজ করেছেন। ফলে জি এম কাদের জাপার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্ত থাকতে পারছেন না। এ আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন তার আইনজীবী।

তার আইনজীবীরা বলছেন, জি এম কাদেরের দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর আদালতের আদেশ প্রত্যাহার বিষয়ে বাদী-বিবাদীর শুনানির পর আদালত আবেদন খারিজ করেছেন। অর্থাৎ দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জি এম কাদেরের ওপর দেওয়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। এ আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন তারা। জিয়াউল হক ৪ অক্টোবর জি এম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। মামলায় জিয়াউল হকের বহিষ্কারাদেশকে বেআইনি ঘোষণা এবং দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০-এর উপধারা ১(১) অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানানো হয়। মামলায় জি এম কাদের ছাড়াও নির্বাচন কমিশনের সচিব, জাপা মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম দফতর সম্পাদককে বিবাদী করা হয়। জিয়াউল হক জাপার সাবেক সংসদ সদস্য এবং দলের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জি এম কাদেরের পক্ষে বলা হয়েছে, জিয়াউল হককে আইন মেনে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদপদবি থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর অব্যাহতি পাওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গা ২৩ অক্টোবর একটি মামলা করেন। ওই মামলার শুনানি নিয়ে আদালত কেন দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জি এম কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না, সে বিষয়ে তাকে কারণ দর্শাতে বলেছেন। ১৫ দিনের মধ্যে নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই মামলায়ও আপত্তি দাখিল করার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেছেন জি এম কাদের। আগামী ২ জানুয়ারি এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

জানা যায়, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেই এসব মামলা সামনে এসেছে। জি এম কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আগামী ২৬ নভেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। আজ ১৯ নভেম্বর বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহের টাউন হল ময়দানে জাতীয় পার্টির কর্মী সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের ডেপুটি মেয়র মরহুম জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের স্মরণসভায় গতকাল যোগ দেওয়ার কথা ছিল জি এম কাদেরের। কিন্তু আইনি জটিলতায় যাননি। নেতা-কর্মীরা বলছেন, জাপার চেয়ারম্যানকে কেন্দ্র করেই দলের অধিকাংশ কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। তার অনুপস্থিতিতে কর্মকান্ড অনেক কমে গেছে। এই অবস্থায় দলের নেতৃত্বে ভারপ্রাপ্ত কাউকে আনা যায় কি না- এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। 

এ প্রসঙ্গে জি এম কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনি বিষয়ে কথা বলা মুশকিল। এ বিষয়ে দেশের বিজ্ঞ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা জানিয়েছেন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা তাদের বোধগম্য নয়। নজির নেই। জাতীয় পার্টি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। দলের চেয়ারম্যানের কর্মকান্ডের ওপর দলের কর্মকান্ড অনেকাংশে নির্ভর করে। এই নিষেধাজ্ঞা রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। রাজনৈতিক দল বা দলের নেতা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।  আইন প্রণেতারাও যদি জনগণের বিরুদ্ধে কোনো আইন প্রণয়ন করেন তাহলে বিচার বিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। দীর্ঘ পথ চলায় এই দল থেকে অনেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল গঠন করেন। কিন্তু মূল দল হিসেবে দেশের রাজনীতিতে ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন ছিল ৩২টি, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৭টি, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টি। বর্তমানে জাতীয় পার্টির আসন ২৬টি। দলের নীতিনির্ধারকদের মতে, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টি বেশ সরব ও সক্রিয়। বিগত দিনের মতো আগামী সংসদ নির্বাচনেও মূল ফ্যাক্টর হবে জাপা। রাজনীতি নিয়ে যারা ভাবেন, যারা ভোট এবং ক্ষমতার অঙ্ক কষেন, তারা এটা ভালো করেই জানেন জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে সরকার গঠন করা প্রায় অসম্ভব। টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। প্রথমবার তারা জাতীয় পার্টির সঙ্গে মহাজোট গঠন করেই সরকারে যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে দলটি ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনেও মূল অনুঘটকের কাজটি করে জাতীয় পার্টি।

সর্বশেষ খবর