শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অযত্নে অচল উপহার

জয়শ্রী ভাদুড়ী

চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন কার্যালয় চত্বরে খোলা আকাশের নিচে অবহেলায় পড়ে আছে একটি লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স। প্রায় এক বছর ধরে ব্যবহার না হওয়ায় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে দেড় কোটি টাকা মূল্যের বিশেষায়িত এই অ্যাম্বুলেন্স। চালক, নার্স এবং তেলের বরাদ্দ না থাকায় কাজে লাগছে না ভারত সরকারের উপহারের এই অ্যাম্বুলেন্স। শুধু চুয়াডাঙ্গা নয়, দেশের ৬৪ জেলায় দেওয়া ১৬৩ কোটি টাকা মূল্যের ১০৯টি লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে অযত্নে। অবহেলায় ধুলার স্তূপে নষ্ট হচ্ছে আইসিইউ সুবিধা সংবলিত এই অ্যাম্বুলেন্সগুলো। দেড় বছরেও কাজে লাগানো যায়নি ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স। এগুলো পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। বাকি ৬৯টি মাসে দু-এক দিন সাধারণ রোগী বহন করছে। জানা যায়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে আসেন। তখন ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ভারতের সরকারপ্রধান। এসব অ্যাম্বুলেন্সে একটি আইসিইউ পোর্টেবল ভেন্টিলেটর, জরুরি ওষুধ, ইনকিউবেশন সেট, অক্সিজেন সিলিন্ডার, সাকশন মেশিন, নেবুলাইজার মেশিন, ক্যাথেটার, বিপি স্টেথো, পালস অক্সিমিটার, কার্ডিয়াক মনিটর পালস, স্যাচুরেশন, তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র, মনিটর ব্যবস্থা, পথেই রোগীর হৃদস্পন্দন ভেন্ট্রিকুলার টাকাইকার্ডিয়া (ভিটি) এবং ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিলেশন (ভিএফ) সুবিধা থাকে। গত বছর ধাপে ধাপে এই অ্যাম্বুলেন্সগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে ভারত। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সগুলো সচল করতে চালক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি তেলের বরাদ্দ।

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে ১১টি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাতটি অ্যাম্বুলেন্স এখনো ব্যবহার করা যায়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে এসব অ্যাম্বুলেন্সকে কখনো কখনো রোগী বহন করতে দেখা যায়। এসব হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে বাংলাদেশ-ভারতের পতাকা সংবলিত অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে ধুলাবালির আস্তর জমেছে। দীর্ঘদিন একই জায়গায় পড়ে থাকায় ব্যাটারি অকেজো হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স আকারে বড় হওয়ায় অনেক চালক এটি নিয়ে বের হতে চান না। অ্যাম্বুলেন্সগুলো শুধু ঢাকার ভিতরে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. শেখ দাউদ আদনান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সের তেলের বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা আমরা দ্রুতই দিয়ে দেব। অ্যাম্বুলেন্সগুলো সচল করতে চালক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু সময় লাগে। তাই দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সগুলো কাজে লাগাতে আমরা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে চালক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।’ নারায়ণগঞ্জে উপহারের একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে অচল। নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে এ বছরের ৩০ জুন আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু চালক ও জ্বালানি বাবদ কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে অচল পড়ে আছে অ্যাম্বুলেন্স। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাইফ সাপোর্টসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত তিনটি অ্যাম্বুলেন্স রোগী পরিবহনের কোনো কাজে আসছে না। অ্যাম্বুলেন্সগুলো গ্যারেজে পড়ে আছে। অচল হতে চলেছে দামি এই অ্যাম্বুলেন্স। গত বছরের ২৯ অক্টোবর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল, আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেওয়া হয়। জানা গেছে, আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকা অ্যাম্বুলেন্স গ্যারেজে পড়ে আছে। চালানো হয় না বলে এর ব্যাটারি অকেজো হওয়ার পথে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল ও কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সগুলো শুধু করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো দিয়ে রোগী আনা-নেওয়া করা হয় না। ২৫০ শয্যা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ ওয়াহীদুজ্জামান বলেন, ‘ভারতের দেওয়া উপহারের অ্যাম্বুলেন্সটি চালাতে চালকের অনীহা রয়েছে। চালক বলছেন যে, অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যে কারণে ঝুঁকি নিতে চান না। এ অবস্থায় এখন করোনার ভ্যাকসিনের কার্যক্রমে লাগানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সটিকে।’ খাগড়াছড়ি জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে ছয় মাস ধরে পড়ে আছে লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স। লোকবল না থাকায় চলছে না অ্যাম্বুলেন্সটি। নোয়াখালীতে উপহারের অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্স দুটি জনবল সংকটসহ নানা সমস্যায় এক বছর ধরে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে। এর একটি দেওয়া হয়েছে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে, আরেকটি সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। শুধু উপহারের নয়, নিজস্ব অর্থায়নে কেনা অ্যাম্বুলেন্সও পড়ে আছে অযতেœ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে দেড় কোটি টাকা দামের একটি অত্যাধুনিক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের (আইসিইউ) অ্যাম্বুলেন্স অযথাই পড়ে আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মী না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সটির এ অবস্থা। রামেক কর্তৃপক্ষের তথ্যানুসারে, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ১ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৮৫৫ টাকা ব্যয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি কেনার পর ২০১৯ সালের মে মাসে এটি রামেকে পাঠানো হয়। তারপর থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ অ্যাম্বুলেন্স একজন রোগী বহন করছে। রামেক হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সটি পরিচালনা করতে যে জনবল প্রয়োজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেটি দেয়নি। এ ছাড়া এর সেবা পেতে মূল্য দিতে হবে। সেটি কত দিতে হবে, তাও নির্ধারণ করা নেই। ফলে এটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এখন সেটি গ্যারেজে পড়ে আছে।’ [প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আমাদের প্রতিনিধি- কাজী শাহেদ, রাজশাহী; জামান আখতার, চুয়াডাঙ্গা; নোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ; হাসানুর রহমান ঝন্টু, বরগুনা; মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া; মো. জহুরুল আলম, খাগড়াছড়ি; আকবর হোসেন সোহাগ, নোয়াখালী]

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর