একের পর এক খুনের ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে আতংকের জনপদ লক্ষ্মীপুর। গত সাত মাস আগে যুবলীগ নেতা আলাউদ্দীন খুনের পর এবার জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম খুনের পর রীতিমতো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে লক্ষ্মীপুরে। তবে এরই মধ্যে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই বশিকপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কাশেম জিহাদীর নিশানায় ছিলেন নোমান ও রাকিব। গত ২০ ডিসেম্বর পোদ্দার বাজার কায়কোবাদ অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানেও মারধরের পর প্রকাশ্যেই রাকিবকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন জিহাদী। অন্যদিকে, জিহাদীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত হলেও যুবলীগ নেতা আলাউদ্দীন খুনেও তার সম্পৃক্ততা ছিল বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার চারজনকে আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
অনুসন্ধান এবং তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অবস্থানগত কারণে লক্ষ্মীপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বশিকপুর ইউনিয়ন। নোয়াখালী সংলগ্ন হওয়ায় সেই জেলার অনেক অপরাধীর অন্যতম পছন্দের আশ্রয়স্থল বশিকপুর। ২০১৭ সালে লাদেন মাসুদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর থেকেই আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন কাশেম জিহাদি। বশিকপুর থেকেই জেলার রাজনীতি, আন্ডারওয়ার্ল্ড, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের বড় একটি অংশের একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। তার অধীনে রয়েছে দেড় শতাধিক সশস্ত্র ক্যাডার। জেলার একজন সংসদ সদস্যের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের কারণে সবকিছুকেই থোড়াই কেয়ার করতেন জিহাদী । এ ছাড়াও সরকারের শীর্ষ মহলে যাতায়াত রয়েছে এমন একজন ব্যক্তির আশীর্বাদ থাকায় কাউকেই পরোয়া করতেন না তিনি। এর বাইরেও দলের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকেও নানাভাবে ম্যানেজ করে আসছিলেন জিহাদী ।
সূত্র জানায়, লাদেন মাসুদের ক্যাডারদের একটি অংশকে নিজের গ্রুপে ভিড়িয়ে নেন। তবে জিহাদী র বাইরে থেকে যাওয়া কিছু সশস্ত্র ক্যাডারের সঙ্গে অতি গোপনে সমঝোতা করেন জিহাদী র সেকেন্ড ইন কমান্ড আলাউদ্দীন। তাদের দিয়ে এলাকা ও এলাকার বাইরে কন্ট্রাক্ট ভিত্তিক কিছু কাজ করিয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, গত বছরের শুরুতে এ বিষয়টি আঁচ করতে পারলেও নিজের নির্বাচনের কারণে আলাউদ্দীনকে কিছুই বুঝতে দেননি জিহাদী । মাহফুজুর রহমানের কাছে নির্বাচনে হার এবং আলাউদ্দীনও তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে এক সময় হাত মেলাতে পারেন এমন আশঙ্কা দানা বাঁধে জিহাদীর। গত ৩০ সেপ্টেম্বর খুন হন আলাউদ্দীন। এ ঘটনাটিকে প্রথমে নোমানের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন জিহাদী । জিহাদী র বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, ডাকাতিসহ অতীতে ২৩টির মতো মামলা ছিল। তবে বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা এবং একটি চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ।গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আমরা আইনের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে চারজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিহাদি এখনো দেশ ত্যাগ করতে পারেনি। কারা, কেন এ হত্যা করেছে আশা করি তা বের হয়ে আসবে।
র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর পাশা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কী কারণে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কারা জড়িত বিষয়টি নিয়ে র্যাব শুরু থেকেই কাজ করছে। একজন আসামিও আমরা গ্রেফতার করেছি। পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, আবুল কাশেম জিহাদি শুরুতে ছিলেন ডাকাত। এরপর জামায়াতের সক্রিয় কর্মী। পরে জামায়াত ত্যাগ করে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত তার নাম ছিল আবুল কাশেম। এরপর রকেট লঞ্চার চালানোসহ নানা কারণে তিনি জিহাদি কাশেম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অভিযোগ রয়েছে, নামের সঙ্গে ‘জিহাদি’ যুক্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৯৮ সালে জামায়াত ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর দুবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে চারটি হত্যাসহ ২৩টি মামলার আসামি হন তিনি। বর্তমানে চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম জিহাদি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, আবুল কাশেম জিহাদি ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাদ যাননি দলীয় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। জমি দখল, চাঁদাবাজি, হামলা, মামলা ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। তার কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলেই নেমে আসত নির্মম নির্যাতন ও খুনখারাবি। বশিকপুরসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষ তার ভয়ে শঙ্কিত থাকে। তবে রহস্যজনক কারণে ক্ষমতার পালা বদলেও বহাল তবিয়তে জিহাদি।
রিমান্ডে চার আসামি : জোড়া খুনের মামলায় গ্রেফতার চার আসামিকে আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল দুপুরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ভিক্টোরিয়া চাকমা এ আদেশ দেন। দুপুর আড়াইটার দিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দত্তপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা আসামিদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেছি। আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এ মামলায় অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রিমান্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন ইসমাইল হোসেন পাটোয়ারী, মো. সবুজ, মনির হোসেন রুবেল ও আজিজুল ইসলাম বাবলু। প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার রাতে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সড়কে সন্ত্রাসীরা যুবলীগ নেতা নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিবকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও মোবাইল নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। ঘটনার ২৭ ঘণ্টা পর কাশেম জিহাদিসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নোমানের বড় ভাই ও বশিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান। ঘটনার পর স্থানীয় একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে অস্ত্র হাতে আটজন যুবককে হাঁটতে দেখা যায়।