চার ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে আগামীকাল ১৫৬টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে ৭০ দশমিক ৫১ শতাংশ চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং ৬৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীই ব্যবসায়ী। প্রথম ধাপে এই হার ছিল যথাক্রমে ৭০ শতাংশ ও প্রায় ৬৭ শতাংশ। উভয় ধাপে প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ নেতা। প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১০ বছরে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৩৬ শতাংশ, ৫ বছরে বৃদ্ধির এই হার সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ আর স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৯৬৮ শতাংশ। পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের পেছনে ফেলেছেন উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। একজন সংসদ সদস্যের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, সেখানে একজন চেয়ারম্যানের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার সাড়ে ১১ হাজার শতাংশের বেশি। গতকাল ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানায় সংস্থাটি। প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া আট ধরনের তথ্যের বহুমাত্রিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছে টিআইবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। তাদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যতটুকুই আছে, তাতে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা গেছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পদ বৃদ্ধির একটি যোগসূত্র দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগ) প্রার্থী, অনেকেই ক্ষমতাশীলদের আত্মীয়। প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য ও পুরুষের আধিক্য রয়েছে। ক্ষমতা ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে রাজনীতির সরাসরি সম্পৃক্ততা দেখা যাচ্ছে। যে কারণে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতান্ত্রিক ও শুদ্ধাচার চর্চা দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক আদর্শ এখানে বড় বিষয় নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশ্লেষণ দেখা যায়, ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি। তিন গুণ হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা। প্রায় ২৫ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ কিংবা দায় রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৩১০ দশমিক ৯৪ কোটি টাকা ঋণ আছে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর। প্রার্থীদের ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত।
টিআইবি জানিয়েছে, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪২ দশমিক ৪৯ শতাংশ আয় দেখিয়েছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০ শতাংশ প্রার্থী। চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য আয় বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশের আয় সাড়ে ১৬ লাখ টাকার ওপরে, যা অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে মাত্র ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। আবার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২১ শতাংশের আয় সাড়ে ৩ লাখ টাকার নিচে, অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে অপেক্ষাকৃত ধনীরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
টিআইবি বলছে, দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচন দলীয় হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে দলীয়ভাবে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের অধিকাংশই ‘আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী’ এবং দলটির স্থানীয় মন্ত্রী অথবা সংসদ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট। এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া বিএনপি দ্বিতীয় ধাপেও তাদের ৬৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে।
অন্যদিকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচিত হননি এমন প্রার্থীদের গত ৫ বছরের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তুলনায় দেখা গেছে, অনির্বাচিতদের তুলনায় দ্বিগুণ সম্পদ বেড়েছে নির্বাচিতদের। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে শুধু নির্বাচিতদের নিজেদেরই নয়, তাদের স্ত্রী-স্বামী ও নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আবার যেসব জনপ্রতিনিধি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন তাদের আয় ও সম্পদ বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতাও স্পষ্ট। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় এবার ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশে। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৭০ দশমিক ৫১ শতাংশ, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৯ দশমিক ২৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫১ দশমিক ৬৩ শতাংশ নিজেকে গৃহিণী বা গৃহস্থালি কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। এদিকে প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপেও আলোচনায় আছেন মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার নির্দেশ দিলেও দ্বিতীয় ধাপের লড়াইয়ে চেয়ারম্যান পদে মন্ত্রী-এমপিদের ১৭ জন স্বজন রয়েছেন বলে জানিয়েছে টিআইবি। এর আগে প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের ১৩ জন স্বজন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। মন্ত্রী-এমপিদের ১৭ জন স্বজন হলেন- নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায় নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছোট ভাই নজরুল মজিদ মাহমুদ, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ, কুমিল্লা সদরে আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই গোলাম সারওয়ার, জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় নূর মোহাম্মদের ভাই নজরুল ইসলাম, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলায় জিল্লুল হাকিমের চাচাতো ভাই ইহসানুল হাকিম সাধন, দৌলতপুর উপজেলায় রেজাউল হক চৌধুরীর ভাই বুলবুল আহমেদ টোকন, নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলায় মাশরাফি বিন মুর্তজার চাচাশ্বশুর ফয়জুল হক রোম, চুয়াডাঙ্গা সদরে সুলাইমান হক জোয়ারদারের ভাইয়ের ছেলে নাঈম হাসান জোয়ারদার, শরীয়তপুর সদরে ইকবাল হোসেন অপুর চাচাতো ভাই বিল্লাল হোসেন দিপু মিয়া, বগুড়ার আমদিঘি উপজেলায় মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ মেহেদির পিতা সিরাজুল ইসলাম খান রাজু, নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় মোরশেদ আলমের ছেলে সাইফুল ইসলাম দীপু, ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় আলী আজম মুকুলের ভগ্নিপতি মোহাম্মদ জাফর উল্লাহ, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় রুমানা আলীর বড় ভাই জামিল হাসান দুর্জয়, সিলেটের উহাবল উপজেলায় মোহাম্মদ আবু জাহিরের শ্যালক আখতারুজ্জামান, পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় মোহাম্মদ মকবুল হোসেনের ছেলে গোলাম হাসনাইন, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে নুর উদ্দিন চৌধুরীর ভগ্নিপতি মামুনুর রশিদ ও লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে রাকিবুর জামান।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        