রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

তলানিতে শিল্প উৎপাদন

কর্মসংস্থানে নিম্নগতি ♦ জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ♦ কমেছে রপ্তানি

শাহেদ আলী ইরশাদ

তলানিতে শিল্প উৎপাদন

উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে কমেছে চাহিদা, ডলার সংকটে বেড়েছে কাঁচামাল ও জ্বালানি খরচ। কমেছে রপ্তানি, বেড়েছে সুদহার। চলছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। এসব কারণে শিল্পকারখানার উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি সবনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থান ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে। কারণ দীর্ঘমেয়াদে ডলার সংকট, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, জিনিসপত্রের উচ্চ দামের কারণে চলতি অর্থবছরেও জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কম হতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ৩ দশমিক ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে কৃষি খাতে; যা আগের অর্থবছরের তুলনায় দশমিক ১৬ শতাংশ কম। আগের অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, মহামারির প্রথম বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরেও কারখানার উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়েছিল। সংস্থাটি বলছে, শিল্প ও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমলেও সেবা খাতের বাড়বে দশমিক ৪৩ শতাংশের মতো। চলতি অর্থবছরে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হবে; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। উৎপাদন খাতের প্রাণ হলো দেশের ৪৬ হাজারের বেশি ছোটবড় কলকারখানা। এসব কলকারখানার মূল জ্বালানি বিদ্যুৎ ও গ্যাস।

তবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন খাত ইতোমধ্যে নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা, বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড় ঘাটতি ইত্যাদি কারণে দেশের উৎপাদন খাত ব্যাহত হয়েছে। শিল্প খাতের মূল বিষয় হলো উৎপাদন খাত। এটি ব্যাহত হচ্ছে আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যুতের সংকট ছিল, গ্যাসের সংকট ছিল এগুলো এখনো আছে। একই সঙ্গে রপ্তানিও কম হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের শিল্প খাতে প্রভাব পড়েছে। শিল্প খাতের আরেকটি বড় অংশ জ্বালানি খাত। এ খাতও ব্যাহত হয়েছে। কারণ আমরা গ্যাস আমদানি করতে পারিনি। যার কারণে বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খাতের ধীরগতির কারণেই দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে।’ সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হবে; যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৪৪ লাখ ৯০ হাজার কোটি। বিবিএস চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে অন্তর্বর্তীকালীন এ আনুমানিক প্রক্ষেপণ করেছে। বিবিএসের তথ্যমতে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (মার্চ পর্যন্ত) মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য উপকরণ আমদানি ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ কমে ৪৫৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ১৯ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। তার পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়েনি। ফলে অর্থনীতির গতি আরও ধীর হতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। জ্বালানির দাম বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। শিল্পোৎপাদন বাড়ানোর জন্য কারখানা মালিকরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে রপ্তানি বেড়েছিল ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। চলতি বছরের একই সময়ে বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক থেকে এলেও পোশাক বিক্রি কমে গেছে। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। এমন পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। আবার অনেকেই চাকরিও হারাতে পারেন। শিল্প খাতের এমন দুরবস্থার মধ্যে দেশের ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে গত ৮ মে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে ঋণের সুদহার। ফলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে গেছে। ২০২৩ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশে, যেখানে ২০২২ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি আমিন হেলালী বলেন, ‘জ্বালানি খরচ বেশি হওয়ায় শিল্প খাত অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি ছিল। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ঋণের সুদহার বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫.৭ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হয়েছে। একইভাবে ডিজেলের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ এবং ফার্নেস অয়েলের ৪১.৪ শতাংশ। শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বেড়ে ১৭৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ খবর