ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারির অনুরোধ জানিয়ে ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন অফিস।
পুলিশের মহাপরিদর্শকের মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গতকাল ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান।
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ইন্টারপোলকে অ্যাড্রেস করে চিঠিটি আইজিপির কাছে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর এটা ইন্টারপোলে পাঠাবে। তিনি বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত, তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেন্ডিং আছে, কিন্তু বাংলাদেশের জুরিসডিকশনের বাইরে তিনি চলে গেছেন, সে কারণে আন্তর্জাতিক পুলিশিং সংস্থা হিসেবে ইন্টারপোল যাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা নেয় এবং তাঁর ব্যাপারে অন্তত রেড অ্যালার্ট জারি করে, সে ব্যাপারে আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি।’ কীভাবে পাঠিয়েছেন-এমন প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এটা কমিউনিকেট করার দায়িত্ব পুলিশের আইজির। আমরা সরাসরি লিখেছি ইন্টারপোলের কাছে। এটাই যাবে।’
এর আগে রবিবার পলাতকদের ধরতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিস’ জারি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। ওইদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কারকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন শেষে এ কথা বলেন তিনি। ১৭ অক্টোবর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের পৃথক মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হয়। গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রায় সব অভিযোগেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনার তারিখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে গণহত্যার অভিযোগগুলোয়। এ ছাড়া এ সময়ে আহত হয়ে পরে বিভিন্ন তারিখে নিহতরাও এর আওতায় থাকবেন। ঘটনার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে। অপরাধের ধরনে বলা হয়েছে, প্রধান আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশি ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে চলছে বিচারকাজ।
গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের কিছুদিন পরই ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরে যান। আর এক সদস্যকে হাই কোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। অন্য সদস্য অব্যাহতি নেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউটররা পদত্যাগ করেন। পরে ৫ সেপ্টেম্বর চিফ প্রসিকিউটরসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ।
১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর ১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল। গত মঙ্গলবার তাঁদের এজলাসে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আর প্রথমবারের মতো গতকাল বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।
আরও চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা : যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ইন্সপেক্টর (তদন্ত) জাকির হোসেনসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। পরে এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং আপনাদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল যে একজন তরুণকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে যখন তার সহকর্মী নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সে স্বাভাবিক অবস্থায় বেঁচে ছিল, তার পায়ে আঘাত ছিল সামান্য। সেই ছেলেটিকে কাছে গিয়ে বুকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করে এবং লাশটিও নানাভাবে বিকৃত করে। তিনি হচ্ছেন যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাকির হোসেন। তিনি এখন পলাতক। জাকির হোসেনসহ আরও চারজন পুলিশ কর্মকর্তা, যারা যাত্রাবাড়ীর অ্যাট্রোসিটির (হত্যাযজ্ঞ) সঙ্গে জড়িত, যাদের বিরুদ্ধে আমরা অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি, এ রকম চারজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছিলাম। আদালত সেটা মঞ্জুর করেছেন। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, হয়রানির শিকার হতে পারে ভেবে পুলিশ বাহিনী নানাভাবে দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করছে। কোনো নির্দোষ পুলিশ কর্মকর্তাকে হয়রানি করা হবে না বলে জানান তিনি। যাদের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাবে, তারা কেউ ছাড় পাবেন না বলেও তিনি জানান।