দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে ২ কোটি লোক দারিদ্র্যঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এদের মাসিক আয় গরিবি সীমার (পভার্টিলাইন) এত কাছাকাছি যে, মাসে দুই দিন কাজ না করলেই তারা দরিদ্র হয়ে যাবে। তখন গরিব মানুষের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হবে। বিগত সরকারের অর্থনৈতিক অনিয়মের ওপর ভিত্তি করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণীত শ্বেতপত্রে এসব পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা বলছেন, বিগত ১৫ বছর উন্নয়নের যে বয়ান রচিত হয়েছে, তা এতটাই ভঙ্গুর যে, টোকা দিলেই ঝরে যাবে। তাঁদের দাবি, প্রবৃদ্ধির সুফল গেছে মূলত ১০ ভাগ মানুষের ঘরে। বাকি ৯০ ভাগ মানুষের ঘরে গেছে তলানির ছিটেফোঁটা অংশ। দুর্নীতি, লুটপাট, আয়বৈষম্য আর অসমতার কারণে প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে সঠিকভাবে পৌঁছেনি। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘২০১৬ ও ২০২২ সালের খানা আয়ব্যয় জরিপ পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি, বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের যে গল্প ছড়ানো হয়েছে সেটা আংশিক সত্য। দারিদ্র্যের হার কমে ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে এটা সত্য, তবে দারিদ্র্যসীমার ওপরে আরও ২ কোটি লোক রয়েছে। তারা অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। কোনো কারণে এ লোকগুলো মাসে দুই দিন কাজ না পেলে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। অর্থাৎ নতুন করে এ ২ কোটি লোক গরিব হয়ে যাবে। তখন দারিদ্র্যের হার বর্তমানের ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৬ শতাংশে চলে যাবে। বর্তমানে যে ৩ কোটি লোক গরিব রয়েছে, এটি বেড়ে ৫ কোটি হয়ে যাবে।’
ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘এ দারিদ্র্যঝুঁকির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মূলত আয়বৈষম্য। প্রবৃদ্ধি যা হয়েছে তার বেশির ভাগই চলে গেছে সমাজের উচ্চশ্রেণির একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে। সমাজের বাকি যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তারা পেয়েছে মূলত তলানিটা।’ শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে চলে গেছে দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ। আর বাকি ৯০ শতাংশের হাতে রয়েছে ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বাড়িয়েছে সেই ১০ শতাংশ মানুষ। আর এ অসমতা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে পরের বছরগুলোয়।
আয়বৈষম্য পরিমাপের ‘গিনি সহগ’ পর্যালোচনা করে শ্বেতপত্রে দেখানো হয়েছে, ২০২২ সালে গিনি সহগ দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯-এ, যা ২০১৬ সালে ছিল দশমিক ৪৮২। গিনি সহগ শূন্য শতাংশ মানে পূর্ণ সমতা, সবার সমান আয়। এরপর এটি বেড়ে ১ শতাংশে গেলে চরম অসমতা ধরা হয়। অর্থাৎ একজনের হাতে সব আয়। ফলে ২০১৬ থেকে ২০২২ সালে গিনি সহগ বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে এ সময়ে দেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ‘খানা আয়ব্যয় জরিপ ২০২২’ বলছে, বাংলাদেশে বছরে যে আয় হয়, তার ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশই যায় শীর্ষ ৫ শতাংশ পরিবারের কাছে। ২০১৬ সালে শীর্ষ ৫ শতাংশ পরিবারের কাছে যেত ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ আয়। বিপরীতে ২০২২ সালে দেশের দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবার পেয়েছে ১ শতাংশের কম আয়, যা মোট আয়ের দশমিক ৩৭ শতাংশ। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, শীর্ষ ১০ শতাংশ পরিবারের কাছে যাচ্ছে দেশের মোট আয়ের ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৬ সালে এ ১০ শতাংশ পরিবারের আয় ছিল দেশের মোট আয়ের ৩৮ দশমিক ০৯ শতাংশ। তালিকার নিচের দিকে স্থান পাওয়া ৫০ শতাংশ পরিবার পেয়েছে দেশের মোট আয়ের ১৯ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২০ দশমিক ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ওপরের ১০ শতাংশ মানুষের আয় বাড়লেও বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। বেড়েছে অসমতাও।