সরকারের ছত্রছায়ায় নতুন রাজনৈতিক দল ‘কিংস পার্টি’ গঠনের আলোচনা এখন তুঙ্গে। রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে কিংস পার্টি গঠন করলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক দলকে কিংস পার্টি নয়, পাবলিকের পার্টি হতে হবে। তিন নেতার সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত। কথা বলেছেন শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও আকতারুজ্জামান
ক্ষমতায় থেকে কিংস পার্টি করলে পরিণতি ভালো হয় না
রুহুল কবির রিজভী
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে কিংস পার্টি তৈরি করলে তার পরিণতি ভালো হয় না। তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে দেশ ভালো দিকে যাবে। যে বিষয়গুলো মানুষ ইতিবাচকভাবে নেবে সেগুলো সরকার বিবেচনায় আনবে। বিতর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করা হলে বিতর্ক বাড়বে। তাই দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য যেগুলো অপরিহার্য সেগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত। গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির তৎপরতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনায় কিংস পার্টি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ কথা বলেন তিনি। রিজভী আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা। আমরা আশা করি এ সরকার আওয়ামী সরকারের পুনরাবৃত্তি করবে না। এ সরকার মানুষের কাছে আরও বেশি প্রসারিত হতো যদি দ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করত। সরকারের কেউ কেউ বলছেন, এত তাড়া কীসের। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ১৫ বছর জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মানুষের অধিকার। শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচনের দরকার ছিল না। কে এমপি হবেন, চেয়ারম্যান হবেন সব নির্ধারণ করত হাসিনা। নমিনেশন পেলেও পাস। আর পাস করলেই করা যেত লুটপাট ও দখলবাজি। এরপর নিজেরাই মারামারি, খুনাখুনি করত। শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তেই মানব পাচারকারী, স্বর্ণ চোরাকারবারি এবং ডাকাতও এমপি হয়েছেন। তিনি বলেন, নিউইয়র্কে যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ধনী ব্যক্তিরা বসবাস করেন সেখানেও আওয়ামী লুটেরাদের প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনি বলেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানা, অনিয়মকে না বলাই সংস্কার। সরকারপ্রধান যদি কাউকে অন্যায়ভাবে জেল দিতে বলেন, সাজা দিতে বলেন আর বিচারক যদি না বলেন এটিই সংস্কার। ডিসি-এসপিরা যদি মন্ত্রী-এমপির অন্যায় আদেশ না শুনে সঠিক পথে কাজ করেন এটিই সংস্কার। যেটি শেখ হাসিনার আমলে হয়নি। খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে নিম্ন আদালত পাঁচ বছর সাজা দিল। উচ্চ আদালত তা ১০ বছর করল। নিম্ন আদালতে যে পাঁচ বছর সাজা দিল তাকে পদোন্নতি দেওয়া হলো, আবার যে বিচারপতি ১০ বছরের সাজা দিল তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। যে বিচারক একটি মিথ্যা মামলায় তারেক রহমানকে খালাস দিয়েছেন তাকে দেশছাড়া করেছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আজ চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে। নয় ব্যক্তি ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হলো। সরকার প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছে না। আমরা কিছু বললে বলেন, রাজনীতিবিদরা ৫৪ বছরে কিছুই করতে পারেনি। ১৯৭১, ’৯০ এবং ’২৪ সবকিছুই রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে হয়েছে। আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) বিদ্যুৎ বন্ধ করে সংস্কারের মাস্টারপ্ল্যান করবেন সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। দেশ ও জনগণের আপনাদের প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে তা বজায় রাখুন।
লুটতরাজ করতে পারবে না তাই জুজুর ভয় দেখাচ্ছে বিএনপি
সামান্তা শারমিন
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেছেন, বিএনপির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আমাদের কিংস পার্টি বলছেন। আসলে তারা জনগণকে একটা জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন। এটা তাদের নিজেদের ভয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না খুঁজে দেখা প্রয়োজন। আমরা বলেছি সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে, এ ইস্যুতে তারা একমত হতে পারেননি। তারা হয়তো মনে করেন, সংবিধান পরিবর্তন হলে দেশের নীতিনির্ধারণী জায়গাগুলোতে যদি বড় পরিসরে পরিবর্তন বা সংস্কার হয় তাহলে তাদের দলের বিভিন্ন অংশে যে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটতরাজ ও সন্ত্রাস হয় এগুলো তারা করতে পারবে না। এগুলোর ইতিহাস তো আছে তাদের। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
সামান্তা শারমিন বলেন, বিএনপি এ মুহূর্তে যে নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখছে, সেই সাজানো সংসার হয়তো আর হবে না- এ কারণে তারা হয়তো আমাদের কিংস পার্টির অপবাদ দিচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি, তারা এ দেশের তরুণ সমাজের প্রাণের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারবে এবং এ ধরনের জুজুর ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকবে। সবাই মিলে এখন দেশ পুনর্গঠনের কাজটি করা প্রয়োজন। কিন্তু তারা কেন বিভ্রান্ত হয়ে জনগণকে অন্যদিকে ঠেলে দিচ্ছে তা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। সামান্তা শারমিন বলেন, যারা আমাদের কিংস পার্টি বলছেন, তারা অভ্যুত্থানে নিজেদের শক্তি দাবি করেন। কিন্তু তাদের দলের এ দেশে আসার বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বিএনপি স্বাধীন দেশের প্রথম কিংস পার্টি। আমরা এ কথাগুলো বলতে চাইনি। কিন্তু আমরা দেখেছি আমাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে বিএনপি। আমরা দোষারোপের রাজনীতি করতে চাই না। আমাদের অনেক সাংগঠনিক কাজ রয়েছে। মুখপাত্র শারমিন বলেন, আমরা এখনো সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি। সাংগঠনিক কর্মকা ই রাজনৈতিক দল গঠনের একমাত্র হাতিয়ার। দলের নাম কী হবে, নেতৃত্বে কারা থাকবেন, দলপ্রধান কে হবেন এসব নিয়ে চিন্তা করছি না। আমরা মানুষের ঐক্যবদ্ধতা ও সংহতি তৈরির কাজ করছি। আর আমাদের দলের নাম কী হবে, নেতৃত্বে কারা থাকবেন এগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সময়ের প্রয়োজনে তা পরবর্তীতে নির্ধারিত হবে। জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে তিনি বলেন, অন্যরা জাতীয় নির্বাচন দ্রুত চাচ্ছে আর আমরা দেরিতে চাচ্ছি বিষয়টি এমন নয়। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সংস্কার প্রস্তাবনা কমিশনগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। আমরা মনে করি, এখন সুন্দর সময় রয়েছে পুনর্গঠনের ও কাজগুলো দ্রুত করার।
সামান্তা শারমিন বলেন, আমরাও নির্বাচন দ্রুত চাই, একই সঙ্গে সংস্কারের কাজগুলোও দ্রুত চাই। যে নির্বাচন সামনে রয়েছে তা অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার এবং অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে এসেছে। এ নির্বাচনে আমরা এমন কোনো পরিস্থিতি চাই না যে কোনো কিছু নিয়ে কারও সন্দেহ, আতঙ্ক বা আপত্তি থাকুক। কেউ যেন সন্দেহ না করে যে নির্বাচন কমিশন হয়তো ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি। এটা আমাদের জন্য বড় হতাশার জায়গা তৈরি হবে, যদি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে।
কিংস পার্টি নয় পাবলিকের পার্টি হতে হবে
মাহমুদুর রহমান মান্না
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, বিএনপি জনগণের দল। ৩০-৪০ বছর আগে গঠিত এই দল পুরোমাত্রায় জনগণনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে- জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু এটাকে প্রথম কিংস পার্টি বলা যায় কি না- সেটা ভেবে দেখতে হবে। সারা দেশে কিংস পার্টির আলোচনা প্রসঙ্গে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি এ কথা বলেন। জাতীয় নাগরিক কমিটিকে সামনে রেখে কিংস পার্টি গঠনের বিষয়টি এখন আলোচনায় তুঙ্গে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন? জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রাজনৈতিক দল যে কেউ গঠন করতেই পারে। কিন্তু কিংস পার্টি কেন? নতুন পার্টি যদি করতেই হয়- তাহলে সেটা পাবলিকের পার্টি হতে হবে। ‘নতুন কিংস পার্টি কি দেশে নতুন বিভাজন তৈরি করবে, নাকি নতুন নেতৃত্ব তৈরি করবে?’ - এ প্রসঙ্গে মান্না বলেন, নতুন নেতৃত্ব তৈরি করবে কি না- সেটা দেখতে হবে। দল তো যে কেউ গঠন করতেই পারে। কিন্তু দেখতে হবে তারা কী চায়? তাদের কর্মকাণ্ড দেখে বলা যাবে। ওরা তো আর বিভাজন তৈরি করতে পারবে না, এই কিছু দিন হইচই করতে পারবে আরকি!
‘জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থেকে দল গঠন করেছেন। বিএনপি দেশের প্রথম কিংস পার্টি। কী বলবেন? জবাবে মান্না বলেন, এটা তার মত হতেই পারে। আর এ কথা তো সত্যি যে জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায় থাকতেই দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু সেটাকে প্রথম কিংস পার্টি বলা যায় কি না- সেটাও ভেবে দেখতে হবে। কারণ, ৩০-৪০ বছর পরে সেটা এখন জনগণের দলে পরিণত হয়েছে। বিএনপি এখন জনগণের দল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে- তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে দল গঠন করেননি। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপ্লবীরা এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি আগে সংস্কার পরে নির্বাচন চাচ্ছে- এটা কি তাদের দল গোছানোর জন্য সময় ক্ষেপণ?’ এ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা চলতেই থাকে। কাজেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ জাতীয় নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার করা দরকার- সেটুকু সম্পন্ন করার পর নির্বাচন দেওয়া উচিত। আরও কিছু সংস্কার হয়তো করা যেতে পারে। তবে নির্বাচনটা দিতেই হবে। বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার এসে করবে। এর পরের সরকার এসে আরও সংস্কার করবে। সংস্কার ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকবে।
‘জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, আগে স্থানীয় নির্বাচন দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের বিচার শেষ করে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। নইলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে যাবে। কিন্তু বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন। কী বলবেন?’ এ বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, তারা গণহত্যার বিচার চাইতেই পারে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হোক এটা সবাই চায়। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর জাতীয় নির্বাচন- এটা যৌক্তিক কোনো কথা হতে পারে না। কারণ গণহত্যার বিচার শেষ করতে যদি পাঁচ-দশ বছর সময় লেগে যায়- তাহলে কি পাঁচ-দশ বছর ভোট হবে না? এটা কোনো কথা না। ‘নাগরিক কমিটি আরও বলছে, স্থানীয় সরকারে যারা স্বতন্ত্র তাদের কাউন্সিলর বা প্রশাসক পদে বহাল রাখা উচিত। কিন্তু মাঠপর্যায়ের খবর হলো- যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি, তারাই সেসব নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। তবে কি তাদের এই ফর্মুলা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন?’
এ বিষয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, স্বতন্ত্র কাউন্সিলর বা প্রশাসকরা আওয়ামী লীগের ছিল কি না জানি না- তবে এই ফর্মুলা বাস্তবায়িত হলে আওয়ামী লীগই আবারও পুনর্বাসিত হবে। ‘কিছু কিছু সমন্বয়ক বা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের জামায়াত-শিবিরের লোক বলে মনে করছেন অনেকে। আপনি কি মনে করেন?’ মান্না বলেন, এটা তো হতেই পারে। এর আগেও তো অনেক রাজনৈতিক দলে তাদের অন্তর্ভুক্তির কথা জানা গেছে। এখনো থাকতেই পারে। ‘দেশ কি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে, নাকি প্রশান্তির দিকে যাচ্ছে? জবাবে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রশান্তির ভিতরেও অনেক সময় অনিশ্চয়তা দেখা যায়। এটা আরও কিছুদিন পরে বোঝা যাবে। এর অনেকটাই নির্ভর করবে সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর।