জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে কী হতে যাচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট নয় কারও কাছে। এরই মধ্যে এ ঘোষণা নিয়ে তৈরি হয়েছে তিনটি পক্ষ। ছাত্র সমন্বয়করা দ্রুত ঘোষণা দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে; সরকার চাইছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র তৈরি করতে; আর রাজনৈতিক দলগুলো বিপ্লবের ঘোষণার চেয়ে আগামী জাতীয় সংসদকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে- প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, বিপ্লবের ঘোষণার বিষয়টি এখনো তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে আলোচনার জন্য যোগাযোগ করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে না পড়ায় আবার রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্র সমন্বয়করা। ৬ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ‘ঘোষণাপত্র সপ্তাহ’ উদ্?যাপনের ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরির বিষয়ে সরকার এখনো পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। আর যেহেতেু ছাত্রসমাজ কিংবা সরকার কোনো পক্ষ থেকেই এখনো পর্যন্ত এই ‘ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করা হয়নি, সেহেতু আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি, এই ঘোষণাপত্রের ভিতরে কী থাকবে- সেটি আমার বোধগম্য নয়। কারণ গত ১৫ বছর ধরে দেশের ভিতরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো করেছি আমরা (বিএনপি)। এই দেড় দশকে আমাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন, গুম হয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভিটেমাটি, জমিজমা, সহায় সম্বল সবকিছু হারিয়েছেন। মামলা-হামলা, জেল, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতা মিলে শুধু সে আন্দোলনের ইতি টেনেছে। এখন ৫ আগস্টের পাঁচ মাস পার হয়ে যাওয়ার পর তারা কিসের ‘ঘোষণাপত্র’ দেবে সেটা না দেখে বলা যাবে না।’ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব জনআকাক্সক্ষার প্রতীক। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে এবং স্বাধীনতার পর মানুষের যে সুফল পাওয়ার কথা ছিল তা না পাওয়ার বঞ্চনা থেকেই বিপ্লব হয়েছে। বিপ্লবের স্লোগানই ছিল ইনসাফ। তিনি বলেন, এই সরকার এসেছে জনগণের আকাক্সক্ষার প্রেক্ষিতে। পৃথিবীর অনেক দেশে বিপ্লব পরবর্তী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রয়েছে। আমাদের তাৎক্ষণিক ঘোষণাপত্র আসেনি। এখন বিপ্লবোত্তর দেশ গড়ার জন্য যদি ঘোষণাপত্র দিতে চায় তাহলে যে কেউ দিতে পারে। নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। কোনো নাগরিক, গোষ্ঠী, কিংবা সম্প্রদায় বা দল এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। সেটা যেন বিপ্লবের আকাক্সক্ষা প্রত্যাশা বিপ্লবের যে লক্ষ্যের তার সঙ্গে যেন সাংঘর্ষিক না হয়। দেশের স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী যেন না হয়। ঘোষণায় জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আসতে হবে। এক্ষেত্রে বিপ্লবের যারা অংশীদার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এ ঘোষণাপত্র আসতে হবে।’
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ছাত্র সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়করা এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এর সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে স্ট্যটাস দেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ, মুজিববাদের কবর রচিত হবে। দলমত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের মুক্তির সনদ। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ। ৩৬ জুলাই পূর্ণতা পাক ৩১ ডিসেম্বরে।’ তবে এই ঘোষণার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে এটিকে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম। এরপর ৩০ ডিসেম্বর রাতে যমুনার সামনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করতে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিছুদিনের মধ্যে এ ঘোষণা দেওয়া হবে। ওই দিন রাতে দফায় দফায় বৈঠক করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা এই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি স্থগিত করলেও ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সমাবেশের চার দিন পার হলেও সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্রের বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। একই সঙ্গে ৬ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ‘ঘোষণাপত্র সপ্তাহ’ উদ্?যাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল রাজধানীর বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে এই কর্মসূচির কথা জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ৩১ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র ঘোষণা করার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। সরকার সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে সরকার এখনো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’ ঘোষণাপত্রের বিষয়ে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে দৃশ্যমান কার্যকর উদ্যোগ না দেখলে কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবেন বলে জানান জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে আমরা আগে যা বলেছি, এখনো সে অবস্থানেই আছি। সর্বসম্মতিক্রমে এই ঘোষণা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে ১৫ দিনের আলটিমেটাম বিষয়ে জানতে চাইলে প্রেস সচিব বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো টাইমফ্রেম বেঁধে দেওয়া হয়নি। আমরা বলেছি, কিছুদিনের মধ্যে। আমাদের এটাই বক্তব্য।