১ হাজার ৮৫০টি গুমের অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে কমিশনপ্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা জানান। তিনি বলেন, এই মানুষগুলো গুম হওয়ার পর জীবিত ফেরত আসতে পেরেছেন এবং গুমের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তারা একই ধরনের নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গোপন ঘরে আটক থাকাকালীন তাদের অনেকের একে অপরের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
রাজধানীর গুলশানে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় গুম কমিশনের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারক মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকার কর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস, মানবাধিকার কর্মী ও কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত ৪ জুন গুম কমিশন তাদের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছে। এগুলো হলো- এক. গুমের শিকার ব্যক্তিকে হত্যা করা। দুই. বিচারের আগেই মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশেই বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো। তিন. তাকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা। চার. ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া।
তিনি বলেন, গুমের শিকার ২৫৩ জনের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে- ১. নিখোঁজ হওয়ার সময়ে তাদের নিকটাত্মীয়ের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি, ফৌজদারি মামলা, গুম থাকাবস্থায় সংবাদ প্রতিবেদনের মতো সমসাময়িক প্রমাণ রয়েছে। শুধু এই ২৫৩ জন সমসাময়িক প্রমাণ দাখিল করতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিরা হননি, কারণ তখন এসব ক্ষেত্রে জিডি নেওয়া হতো না। ২. গুম অবস্থা থেকে ফেরতের সময় তাদের সন্ত্রাসবিরোধী মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোনো একটি সংস্থা শিকার করে নেয় যে, ব্যক্তিটি তাদের হেফাজতে আছে। ৩. এই ভুক্তভোগীরা জীবিত আছেন তাই তারা কমিশনকে জানাতে পেরেছেন যে তারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গোপন আটক কেন্দ্রে বন্দি ছিলেন, যেখানে তাদের অনেকের একে অপরের সঙ্গে দেখাও হয়েছে এবং একই ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। এই ২৫৩ জন মানুষের একটি তথ্যভিত্তিক দলিল তৈরি হয়েছে। যেখানে তারা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তাদের অভিজ্ঞতার আশ্চর্যজনক মিল প্রমাণ করে যে, গুমের প্রক্রিয়াটি বিচ্ছিন্ন নয় বরং একটি সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অংশ। এমন ঘটনা কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে দাখিলকৃত ৮১ শতাংশ অভিযোগ জীবিত ভুক্তভোগীদের হলেও, ১৯ শতাংশ অভিযোগ ফেরত না আসা ভুক্তভোগীদের। এবারের প্রতিবেদনে আমরা গুম অবস্থা থেকে ফিরে না আসা এমন ১২ জন ভুক্তভোগীর বিষয়ে অগ্রগতি তুলে ধরেছি। তাদের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের গুমের জন্য কারা দায়ী তা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছি। চলমান অনুসন্ধানের স্বার্থে এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব না।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের শাসনামলে ভিন্নমত দমন করতে গুমের সংস্কৃতি চালু করা হয়। এজন্য ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে অস্ত্র বানানো হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশে ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ অভিযানের ছাঁয়াতলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গোপন আটক ও নির্যাতনের সংস্কৃতি চালু করা হয়। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছিলেন- মেধাবী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবী থেকে সাধারণ জনগণ। তবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিরাপত্তার কারণে জড়িতদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। জড়িতদের অনেকের বিদেশযাত্রা স্থগিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। এ ছাড়া, ভারত থেকে ‘পুশইন’ করা ব্যক্তিরা গুমের শিকার কি না, তা যাচাইবাছাই করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কমিশনে দাখিলকৃত ১৩১টি অভিযোগের বিষয়ে আইন মোতাবেক জিডি রেকর্ডপূর্বক ভিকটিমদের সন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।
কমিশন সভাপতি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও বহু অপরাধী ও তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের অবস্থানে থাকায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস, অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানারকম ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবুও বহু ভুক্তভোগী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে সে কাহিনি তুলে ধরেছেন। গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব এখন আর অস্বীকার করা যায় না। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে কমিশন সুনির্দিষ্টভাবে দুটি সুপারিশ দিয়েছে- প্রথমত, সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহারের বিষয়ে অবগত হয়ে সেগুলো ন্যায় বিচারের মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান কাউন্টার টেররিজম মেথড ত্রুটিপূর্ণ বিধায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো উপযুক্ত কাউন্টার টেররিজম মেথড বের করা।