সংসদীয় আসন এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল ঘটে তুলকালাম। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আসনের সীমানা নিয়ে শুনানির সময় মারামারি হয়। ঢাকা-১৯ আসন থেকে সাভার উপজেলার দুই ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। চারটি থেকে কমিয়ে তিনটি আসন করার প্রতিবাদে বাগেরহাটে হরতাল ও মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। যশোরের চারটি আসনের সীমানা অপরিবর্তিত রাখার দাবিতে এক সপ্তাহ ধরে যশোর জেলা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো নির্বাচন অফিস ঘেরাও, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমানা নির্ধারণে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। গতকাল নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে শুনানিকালে তিনি বলেন, ‘সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে আমরা পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছি। আইন অনুযায়ী খসড়া সীমানা নিয়ে দাবি-আপত্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবেদনগুলো আমরা বিবেচনায় নিয়েছি।’ আজ খুলনা অঞ্চলের ৯৮, বরিশাল অঞ্চলের ৩৮১ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০টি দাবি-আপত্তির শুনানি হবে। কাল ঢাকা অঞ্চলের ৩১৬টি দাবি-আপত্তির শুনানি হবে। ২৭ আগস্ট রংপুরের ৭, রাজশাহীর ২৩২, ময়মনসিংহের ৩, ফরিদপুরের ১৮ এবং সিলেট অঞ্চলের ২টি দাবি-আপত্তির শুনানি হবে। ১০ আগস্ট পর্যন্ত ৮৩টি আসনের সীমানা নিয়ে ১ হাজার ৭৬০টি দাবি ও আপত্তি জমা পড়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। এগুলোই নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করবে ইসি।
গত ৩০ জুলাই ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া প্রকাশ করে ইসি। এতে ভোটারসংখ্যার সমতা আনতে গিয়ে গাজীপুর জেলায় একটি আসন বাড়িয়ে ছয়টি করা হয়। বাগেরহাটের আসন চারটি থেকে কমিয়ে তিনটির প্রস্তাব করা হয়। পরিবর্তন আনা হয় ৩৯টি আসনে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনের খসড়া সীমানা নিয়ে শুনানির প্রথম দিনে গতকাল সিইসির সামনে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতিতে জড়িয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিএনপির দুই পক্ষ। বেলা পৌনে ১টায় রাজধানীর নির্বাচন ভবনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের আপত্তি-পরামর্শের শুনানিকালে এ ঘটনা ঘটে। ওই দুই আসনের খসড়া প্রকাশের পর পক্ষে-বিপক্ষে আবেদন জমা পড়েছিল। ইসির শুনানিতে অংশ নিয়ে বিএনপির রুমিন ফারহানা ইসির প্রকাশিত খসড়ার পক্ষে তাঁর যুক্তি তুলে ধরেন। তাঁর বিপরীতে বেশ কয়েকজন নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, বিজয়নগর উপজেলা থেকে তিনটি ইউনিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে যুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা উপজেলাকে অখণ্ড দেখতে চান। একপর্যায়ে দুই পক্ষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে, জড়িয়ে পড়ে হাতাহাতিতে। তারপর ইসি কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরে ইসি সচিব আখতার আহমেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনের শুনানি শেষ করেন এবং তাঁদের শুনানিকক্ষ ত্যাগ করার অনুরোধ জানান।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো. আতাউল্লাহর অভিযোগ, তিনিসহ তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলা চালিয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা ও তাঁর সঙ্গে থাকা দলীয় নেতা-কর্মীরা। রুমিন ফারহানার দাবি, আতাউল্লাহ পরিচিত মুখ নন। তিনি এনসিপি থেকে এসেছেন, না জামায়াত থেকে এসেছেন, তা তিনি জানেন না। প্রথমে তাঁকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। তারপর তো আর তাঁর লোকজন বসে থাকবেন না। তাঁর লোকজনও জবাব দিয়েছেন। ঘটনার সময় নির্বাচন ভবনের বাইরেও হট্টগোল হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারী একটি দলকে গেটের সামনে থেকে সরিয়ে দেন। সেখানে জলকামানও প্রস্তুত রাখা হয়।
নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে মারামারির ঘটনাকে ভোট কেন্দ্র দখলের টেস্ট ম্যাচ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এনসিপি দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। গতকাল বিকালে ইসিতে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। তাঁর অভিযোগ, ‘পুলিশ আমাদের নেতা-কর্মীদের ইসিতে ঢুকতে বাধা দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের কীভাবে ফ্রি এক্সিট দিয়েছে। এই নির্বাচন কমিশন কতিপয় পার্টির অফিস হয়ে গিয়েছে।’
শুনানি থেকে বেরিয়ে বেলা ২টার দিকে বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এখানে একটি মারামারি হয়েছে। আমি যেহেতু একজন আইনজীবী, আমি মনে করেছি- আমার কেইস আমি নিজেই প্রেজেন্ট করব। আমার কেইস আমি প্রেজেন্ট করেছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩-এর যিনি প্রার্থী, তিনি সদলবলে ২০-২৫ জন মিলে গুন্ডাপান্ডার মতন, তাঁদের সেখানে আচার-আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক, অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমি মনে করি এটা কমিশনের যে সম্পত্তি, যে গাম্ভীর্য এবং যে সম্মান; সেটার সঙ্গে এটা যায় না।’ গত দেড় দশকে যা ঘটেনি, তাই ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানা। তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘১৫ বছরে যা হয়নি তা হয়েছে। যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের জন্য ১৫ বছর লড়াই করেছি, তারাই আমার গায়ে হাত তুলল। নির্বাচনের আগে সীমানা নিয়ে নিজের দলে এমন পরিস্থিতি হলে নির্বাচনে কী হবে, অনুমেয়। আমাকে মারা হয়েছে, জবাবে আমার লোক তো বসে থাকবে না।’
রুমিন ফারহানা আরও বলেন, ‘মুশকিল হচ্ছে উনি যেহেতু খুব পরিচিত কোনো মুখ নন; উনি এনসিপি থেকে এসেছেন, না জামায়াত থেকে গেছেন আমি জানি না। তবে উনি প্রথম- একজন আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন, পাঞ্জাবি পরা একজন ধাক্কা দিয়েছে। তারপরে আমার লোক তো বসে থাকবে না। আমি তো একজন মহিলা এবং পরে যখন আমার লোকজনকে মারধর করেছে, আমার লোকজন জবাব দিয়েছে।’
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলেছি, এই নির্বাচন কমিশনের ইট থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তার প্রমাণ দেখতে পেয়েছি এখানে। আমাদের দলের সর্বোচ্চ সিনিয়র নেতাদের হামলা করা হয় সিইসির উপস্থিতিতে এবং ইসির সামনে আমাদের নেতাদের হামলা করে সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে বের হয়ে যায়।’ এদিকে গতকাল বিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে এনসিপি। একই সময় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শাহবাজপুর প্রথম গেট এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন রুমিন ফারহানার সমর্থকরা। ঢাকা-১৯ আসন থেকে সাভার উপজেলার দুই ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে গতকাল মানববন্ধন ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন স্থানীয়রা। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বলিয়ারপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢাকামুখী লেন অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় সড়কের ঢাকামুখী লেনে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, গত ৩০ জুলাই নির্বাচন কমিশন বাগেরহাটের চারটি আসনের মধ্যে একটি আসন কমিয়ে জেলায় তিনটি আসন করার প্রস্তাব দেয়। এরপর থেকেই বাগেরহাট জেলাবাসী ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। এরপর থেকে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সর্বদলীয় সম্মিলিত কমিটি গঠন করে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে আসছে তারা। গতকাল আট ঘণ্টা বাগেরহাট জেলা সদরসহ ৯টি উপজেলায় সর্বাত্মক হরতাল ও মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সর্বদলীয় সম্মিলিত কমিটি। ঢাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সামনেও বিক্ষোভ মিছিল এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বাগেরহাটের বিক্ষুব্ধ জনতা।
যশোর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ইসি যশোরের চারটি আসনের সীমানা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত। আসন চারটির সীমানা অপরিবর্তিত রাখার দাবিতে এক সপ্তাহ ধরে যশোর জেলা বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো নির্বাচন অফিস ঘেরাও, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে। একই দাবিতে গতকাল থেকে মাঠে নেমেছে যশোর জেলা জামায়াতও।